মনজু বিজয় চৌধুরী, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:১৮ পিএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:২৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দুই বোন বাঁচিয়ে রেখেছেন যে ভাষা

খাড়িয়া ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা। ছবি : কালবেলা
খাড়িয়া ভাষার প্রতিনিধিত্বকারী দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা। ছবি : কালবেলা

মৌলভীবাজার চা বাগানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী জাতিসত্তা খাড়িয়াদের বসবাস। তাদের মাতৃভাষার নাম খাড়িয়া। চা শিল্পাঞ্চলে কর্মরত অসংখ্য খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর প্রাণের ভাষা ছিল খাড়িয়া। কিন্তু সময়ের গতিধারায় চা বাগান থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে ভাষাটি। বর্তমানে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর আপন দুই বোন ৮০ বছর বয়সী ভেরোনিকা কেরকেটা ও ৭৫ বছর বয়সী খ্রিস্টিনা কেরকেটা আদি খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। জাত-পাত, সংস্কৃতি, ভাষায় বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশের একটি ভাষার শেষ প্রতিনিধি তারা। এই দুজনের মৃত্যু হলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে ঐতিহ্যবাহী ভাষাটি।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানের বর্মাছড়ায় ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা দুই বোন খাড়িয়া ভাষায় কথা বলতে পারেন। তাদের পরিবারের সদস্য ও খাড়িয়া সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের ভাষাটি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নেই। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রকৃত ভাষা খাড়িয়া।

সরেজমিনে শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজঘাট ইউনিয়নের রাজঘাট চা বাগানে ঘুরে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোকজনের দেখা মিললেও ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা ছাড়া আর কোথাও প্রকৃত খাড়িয়া ভাষায় কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। অনেক সন্ধান করে বর্মাছড়া ভেরোনিকা কেরকেটার দেখা হলে এসময় তিনি খাড়িয়া ভাষা ও বাংলায় বলেন, ‘আমাদের মা-বাবা ভারতের রাচি থেকে এখানকার চা বাগানে আসেন। এখানে আমাদের জন্ম হয়। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাবা-মা খাড়িয়া ভাষা বলত। তাদের কাছ থেকে শেখা। বর্তমানে বাগানে অনেক ভাষার মিশ্রণে আমাদের সন্তানরা মাতৃভাষা বলতেও পারে না, এমনকি বুঝেও না। এই বাগানের মধ্যে আমরা দুই বোন খাড়িয়াতে কথা বলতে পারি। সুখ-দুঃখে আমরা আমাদের দুই বোনের মধ্যেই আমাদের ভাষায় কথা বলি। এতে আমাদের প্রাণ খুলে মনের ভাব প্রকাশ করি। পরিবারের অন্যরাসহ বাগানে কারও সঙ্গে আমরা দুই বোন প্রাণ খুলে মনের মতো করে কথা বলতে পারি না। এটাই আমাদের দুঃখ।’

সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাসি, কোড়া, পাংখুয়া, খাড়িয়া, সৌরা, কোডা, মুন্ডারি, মালতো, কন্দ, খুমি, রেংমিতচা, খিয়াং, পাত্র ও লুসাই ভাষা সহ ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে। এসব ভাষাগুলো ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা খুবই কম।

সরকারিভাবে ২০১৯ সালে তৈরি করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর তালিকায় খাড়িয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের মাতৃভাষার নিজস্ব বর্ণমালা থাকার পরও শুধু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খাড়িয়া ভাষা হারানোর পথে।

খ্রিস্টিনা কেরকেটা বলেন, আমরা দুই বোন একই বাগানের পাশাপাশি সেকশনের কলোনিতে সপরিবারে বসবাস করি। এ ছাড়া আর কারও সঙ্গে খাড়িয়া ভাষায় খুব একটা আলাপচারিতা হয় না। এ কারণে খাড়িয়া ভাষাটি অনেকটা মৃত্যুর মুখে।

মাংরা বস্তির খাড়িয়া সম্প্রদায়ে জহরলাল ইন্দোয়ার বলেন, খাড়িয়া ভাষা ফার্সি ভাষা থেকে এসেছে। ভারতের রাচিতে খাড়িয়া ভাষার বহুল প্রচলিত। আমাদের পূর্বপুরুষ যারা রাচি থেকে এদেশে চা বাগানে আসেন, সে সময়ে এই ভাষার ব্যাপক প্রচলন ছিল। চা বাগানগুলোর মধ্যে বহু ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।

লিজা ইন্দোয়ার, শ্রীমঙ্গল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সীমা ইন্দোয়ার বলেন, আমাদের মাতৃভাষা যে খাড়িয়া, তা বাপ-দাদার কাছে শুনেছি। কিন্তু শিখতে পারিনি। বাংলায় লেখাপড়া করি আর বাবা-কাকারাও বাংলা, দেশোয়ালি ও ভাষার সংমিশ্রণে এক ধরনের ভাষায় কথা বলে। যার কারণে আমরা আমাদের মাতৃভাষা এখন বলতে পারি না। এমনকি বুঝিও না। তবে মাতৃভাষা সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক বলে দাবি তাদের।

শ্রীমঙ্গলে রাজঘাট ইউপি চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জি বলেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নিজস্ব ভাষার অস্তিত্ব রয়েছে ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। এর মধ্যে একটি ভাষা খাড়িয়া। তাই এটি সংরক্ষণে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের দাবি জানান।

মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হালিম জানান, যেহেতু দুই নারী ছাড়া দেশে আর কেউ ভাষাটি জানেন না, বোঝেন না বা চর্চা করেন না; তাই সহজেই অনুমেয় যে, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাবে বহু প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভাষা খাড়িয়া।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টাইম জোনের ধারণা এসেছে যেভাবে

সরকারের চাপে বাধ্য হয়ে ওজন কমালেন ৫৪২ কেজি

উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশে নজর জিনপিংয়ের

‘উন্নয়নের নামে লুটপাট করেছে আ.লীগ সরকার’

২৩ নভেম্বর: ইতিহাসের আজকের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

১০

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

১১

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

১২

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

১৩

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

১৪

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১৫

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১৬

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১৭

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৮

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৯

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

২০
X