মো. আমানুল্লাহ আমান, ক্ষেতলাল (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৪৩ পিএম
আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১০:৪৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

নতুন এমপিওভুক্ত মাদ্রাসায় রমরমা ‘ব্যাকডেট’ নিয়োগ বাণিজ্য

জয়পুরহাট জি ইউ আলিম মাদ্রাসা। ছবি : কালবেলা
জয়পুরহাট জি ইউ আলিম মাদ্রাসা। ছবি : কালবেলা

জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল খোশবদন জি ইউ আলিম মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন কৌশলে বর্তমান অধ্যক্ষ মো. একরামুল হকের নাটকীয় কারিশমায় নিয়োগ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে মাদ্রাসার পৌরনীতি প্রভাষক মোছা. অজিফা খান মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ ৮টি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

জানা যায়, ২০২২ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির (আলিম স্তর) এমপিওভুক্ত হয়। গত ৬ জুলাই নতুন করে ২ হাজার ৭১৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছিল সরকার। এরমধ্যে একটি ছিল ক্ষেতলাল খোশবদন জিইউ আলিম মাদ্রাসা। ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে আলিম শাখায় শুরু থেকে যারা শিক্ষক-কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, এমপিওভুক্ত হওয়ার পর তাদের একটি অংশকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, এমপিওভুক্ত হওয়ার পর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নিয়োগ বাণিজ্য করে হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তাদের অভিযোগ, মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ মো. একরামুল হক তার মনোনীত সহযোগীদের নিয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার পর আলিম শাখায় শুরু থেকে চাকরিতে থাকা নিয়মিত ৩ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেছেন। মোটা অংকের টাকা দিতে না পারায় এসব শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করে তাদের স্থলে নতুনদের নিয়োগ দিয়েছেন। শুধু তিনটি ‘প্রভাষক’ পদের নিয়োগে একেকজনের কাছ থেকে ১৫-১৭ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।

নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন বেশি অর্থ প্রদানকারী শিক্ষককে। একইসঙ্গে অর্থ না দেওয়া বা দিতে না পারার কারণে নতুন তালিকায় বাদ পড়েছেন পুরাতন শিক্ষকরা। মাদ্রাসার নিয়মিত শিক্ষক অজিফা খান, মো. সোহেল রানা ও মো. আনোয়ার হোসেনের স্থলে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষক।

মাদ্রাসায় নিজস্ব প্রচারপত্রে চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের নাম আছে, যদিও বর্তমান অধ্যক্ষের দাবি তাদের কেউই এখানে চাকরি করতেন না এবং দু-একজনের অন্যত্র চাকরি হওয়াই চলে গেছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এর ২০১৬ সালের তথ্যে জানা যায়, ক্ষেতলাল খোশবদন জিইউ আলিম মাদ্রাসার মো. সানোয়ার হোসেন, রুহুল আনোয়ার, আনোয়ার হোসেন ও দেলোয়ার হোসেনসহ মোট চারজনকে ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেখানো হয়।

২০১৭ সালের তথ্যে একই তারিখে সোহেল রানা নামের আরও একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেখানো হয়। তারপর ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই পাঁচজন শিক্ষকের একই তথ্য পাওয়া যায়।

২০১৯ সালের তথ্যে দেখা যায়, রাবেয়া সুলতানা নামের আরেক শিক্ষকের (সহকারী শিক্ষক, ইংরেজি পদে) নাম। যার নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর। জন্ম তারিখ দেখানো হয় ১০ অক্টোবর ১৯৮৬। ২০২১ সাল পর্যন্ত রাবেয়া খাতুনের তথ্যও একই থাকে।

২০২১ সালে এসে প্রভাষক আনোয়ার হোসেনকে ইংরেজি, সানোয়ার হোসেনকে বিজ্ঞান, মো. সোহেল রানাকে বিজ্ঞান, মো. দেলোয়ার হোসেনকে বিজ্ঞান এবং রুহুল আনোয়ারকে মানবিক বিভাগের সহকারী প্রভাষক পদে দেখানো হয়।

২০২২ সালে তথ্যে ব্যাপক রদবদল হয়। মানবিক বিভাগের সহকারী প্রভাষক রুহুল আনোয়ার, বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সানোয়ার হোসেন ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক দেলোয়ার হোসেনের নিয়োগ দেখানো হয় ২০১৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এছাড়াও বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. সোহেল রানা ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আনোয়ার হোসেনকে বাদ দিয়ে সেখানে আবু নাছের আকন্দ ও রাবেয়া খাতুনের নাম যুক্ত করা হয়েছে।

ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক রাবেয়া খাতুনের নাম দুইবার দেখানো হয়। একটাতে দেখানো হয় সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) জন্ম তারিখ ১০ অক্টোবর ১৯৮৬। আরেকটাতে দেখানো হয়েছে, প্রভাষক (ইংরেজি), জন্ম তারিখ ৯ অক্টোবর ১৯৮৬।

২০২৩ সালের তথ্যে এসব শিক্ষকের যোগদানের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর থেকে আবারও ২৭ ডিসেম্বর দেখানো হয়। আগের তথ্যে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক দেখানো রাবেয়া খাতুনের নাম বাদ দিয়ে সেখানে মাহফুজুর রহমান নামের আরেকজনের নাম দেখানো হয়।

মো. মাহফুজুর রহমান চপল পূর্বে কর্মরত ছিলেন উপজেলার মিনিগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০১৫ সালের আগের নিয়োগ ও ১১-১২ নিবন্ধন ব্যাকডেটে তার যোগদানের সময় বয়স দেখানো হয়েছে। তিনি ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে সরকারি বেতন ভাতা উত্তোলন করেছেন। ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর শৃঙ্খলা ভঙের দায়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। উক্ত মামলার, ১১৪৪/১/৫ স্মারকে এই সহকারী শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি গত তিন মাস যাবত ক্ষেতলাল খোশবদন আলিম শাখায় ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে ক্লাস নিচ্ছেন। অথচ মাদ্রাসা স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিষ্ঠান চাহিদা মাফিক এনটিআরসির গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এনটিআরসির তত্ত্বাবধানে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়ে থাকে।

এ নিয়ে চাকরিচ্যুত আরেক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করে নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি করেছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ একরামুল হক। টাকা ছাড়া তিনি কিছুই বুঝেন না। মাদ্রাসাটি তিনি অবৈধ বাণিজ্যকেন্দ্র বানিয়েছেন বলে অভিযোগ তার।

মাদ্রাসার ইংরেজি প্রভাষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে পরিশ্রম করেছি। এমপিও হওয়ার পর প্রিন্সিপাল আমাকে অমানসিক নির্যাতন করেন। এখন পর্যন্ত আমি কোনো রিজাইন লেটার দিইনি এবং ব্যানবেইসে আমার নাম আছে। ২০২৩ সালে এনটিআরসির গণ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ বছরের ১ জানুয়ারি বগুড়ার একটি প্রতিষ্ঠানে আমার ইন্ডেক্স হয়েছে। আমার স্থলাভিষিক্ত ইংরেজি প্রভাষক পদে একমাত্র এনটিআরসি নিয়োগ দিতে পারে। প্রিন্সিপাল ব্যাকডেটেড কাউকে নিয়োগ দিয়ে থাকলে এটি তদন্ত করা উচিত।

অজিফা খান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দীর্ঘ ১৩টি বছর চাকরি করেছি। আমাকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত আমি আইনি লড়াই লড়ব।

ক্ষেতলাল খোশবদন জি, ইউ আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. একরামুল হকের বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার প্রতিষ্ঠানে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনেও একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বক্তব্য না দিয়ে দেখা করবেন বলে ফোন কেটে দেন।

মাদ্রাসার সভাপতি অ্যাডভোকেট এস এম মোরশেদ জানান, সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। আমি যতদূর জানি, ২০২১ এর পরিপত্র অনুযায়ী এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকে। সাবেক সভাপতির মৃত্যুর পর সুকৌশলে ব্যাকডেটে এসব শিক্ষকদের নিয়োগ দিয়েছেন বলে আমার কাছেও একটা অভিযোগ এসেছে। আর আমি নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে কিছুই জানি না। অধ্যক্ষ একরামুল হক কীভাবে এসব করেছেন তিনি তার জবাব দেবেন। আমি এসবের মধ্যে নেই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X