বাঁশের তৈরি রকমারি পণ্য আবহমানকাল ধরেই আমাদের আদি ঐতিহ্য। সময় আর যুগের পরিবর্তনে এসেছে অনেক নিত্যনতুন প্রযুক্তি। কিন্তু এখনো প্রয়োজনের তালিকা থেকে বাদ পড়েনি বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র। কখনো প্রয়োজন, কখনো শৈল্পিকসামগ্রী- দুই-ই মেটাতে সক্ষম বাঁশজাত পণ্য। বাঁশের বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ৫০ ধরনের নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন হস্তশিল্প তৈরি করে ভাগ্যবদলে সক্ষম হয়েছেন কুমিল্লা নগরের কাপ্তান বাজার এলাকার মো. জাকির হোসেন।
সারা বছর কেনাবেচা চললেও বছরের এই সময়টাতে বাঁশের তৈরি পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। যার প্রমাণ পাওয়া যায় কুমিল্লা নগরীর চকবাজার ও চৌয়াড়া বাজারে গিয়ে। ১০ থেকে ১৫ জন ব্যবসায়ী নিয়ে এসেছেন বাঁশের তৈরি বাহারি জিনিসপত্র। যেগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বাঁশের চটা দিয়ে চাটায়, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকলি, চলুনি, খলই, পলই, ঝুঁরি, খাঁচি, গুমাই। শহর ও গ্রামের এক শ্রেণির গ্রাহক আছেন যাদের চাহিদার শীর্ষে এখনো এসব জিনিসপত্র রয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসেছেন এসব তৈজসপত্র কিনতে। তবে কয়েকজন ব্যবসায়ী বলছেন, ১০ থেকে ১২ বছর আগেও এসব জিনিসপত্রের যতটা চাহিদা ছিল এখন ঠিক ততটা নেই। যারা কিনছেন তাদের বেশিরভাগই সখের বসে কেনেন।
কুমিল্লা নগরীর কাপ্তান বাজারে নিজ বাড়িতে কথা হয় বাঁশশিল্প কারিগর মো. জাকির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এক সময় প্রত্যেক বাড়িতেই বাঁশ ও বেতের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার ছিল, চাহিদাও ছিল প্রচুর। বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। আবার বাঁশসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে এখন আর আগের মতো পোষায় না।
জাকির হোসেনের বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখা গেল বাড়ির উঠানে বাঁশ ও বেতের সংমিশ্রণে তৈরি ধান মাপার পালা, ধামা, সের, ঢোল, ঝাঁড়ু সারিবদ্ধভাবে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে বসে অনেকে এসব পণ্যে বার্নিশ দিচ্ছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে নগরের কাপ্তান বাজার এলাকায় নিজ বাড়িতে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের নানা ধরনের জিনিস তৈরি করছেন। অসহায় ও হতদরিদ্র নারীদের প্রশিক্ষণও দিয়ে আসছেন। তার তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র ও শৈল্পিকসামগ্রী কুমিল্লাসহ সারা দেশে চাহিদা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য তৈরি করে থাকেন তিনি। আবার স্থানীয় বাজারে ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেন কেউ কেউ। এইসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁড়ি, ফলের ঝুঁড়ি, ফুলদানি, চুলের খোপা, ল্যাম্পসেটসহ আরও অনেক কিছু। তার প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষ শ্রমিক রয়েছে ১৫ জন। তা ছাড়া অসহায় ও হতদরিদ্র নারীদের জন্য রয়েছে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
জানতে চাইলে প্রবীণ সাংবাদিক এম সাদেক বলেন, যতই দিন যাচ্ছে ততই কমে যাচ্ছে এই হস্তশিল্পের চাহিদা। মূল্যবৃদ্ধি, বাঁশ-বেতের দুষ্প্রাপ্যতা, অন্যদিকে প্লাস্টিক, সিলভার ও মেলামাইন জাতীয় হালকা টেকসই সামগ্রী নাগরিক জীবনে গ্রামীণ হস্তশিল্পের পণ্যকে হটিয়ে দিয়েছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে তবুও বাবা-দাদার এই পেশাকে এখনো ধরে রেখেছে কিছু সংখ্যক পরিবার। হয়তো আগামীর শিশুদের সাথে বাঁশের তৈরি হস্তশিল্পের দেখা হবে জাদুঘরে।
লেখক ও সংগঠক সাদিক হোসেন মামুন বলেন, বাঁশ উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীতে অষ্টম। বাংলাদেশে ৩৩ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। ৫০০ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে চীন।
তিনি আরও বলেন, এক সময় বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশ ও বেতের তৈরি আসবাবপত্র। বর্তমানে স্বল্প দামে হাতের নাগালে প্লাস্টিকসামগ্রী পাওয়ায় বেত ও বাঁশশিল্পের চাহিদা আর কমে গেছে। প্রযুক্তির ব্যবহার ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, এটা কাঠের চেয়ে অনেক টেকসই এবং সুন্দর। এর বিকাশের জন্য প্রয়োজন টেকসই বাঁশের উদ্ভাবন এবং এর বাণিজ্যিক চাষাবাদ। এটি একটি লাভজনক পেশা। বাঁশশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।
মন্তব্য করুন