সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২২ আশ্বিন ১৪৩১
ঝালকাঠি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:৫০ এএম
অনলাইন সংস্করণ

আসামির জবানবন্দিতে বেরিয়ে এলো ঝালকাঠির চাঞ্চল্যকর রুবেলের হত্যারহস্য

ঝালকাঠি জেলা ম্যাপ। গ্রাফিক্স : কালবেলা
ঝালকাঠি জেলা ম্যাপ। গ্রাফিক্স : কালবেলা

ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ার বলতলা গ্রামে ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি খুন হন ওই এলাকার বারেক খানের পুত্র রুবেল খান। পরে মরদেহ পাওয়া যায় তার পাশের বাড়ি বাবুল হাওলাদারের ঘরে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হত্যার পর প্রথমে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশের একমাত্র টার্গেটে ছিলেন বাবুল হাওলাদারের স্ত্রী খাদিজা বেগম। এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। ঘটনার দিন তিনি ওই ঘরে ছিলেন। মামলায় ১৪ আসামির মধ্যে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকিরা এখনও পলাতক রয়েছেন।

পরে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল সিআইডি। আদালতে নিজেকে এককভাবে হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন খাদিজা। খাদিজাকে একমাত্র আসামি করে দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেয় মামলার বাদীপক্ষ। এরপরই তদন্তে নতুন মোড় নেয়। প্রায় দুই বছর কারাবন্দি থাকাকালে জেল সুপারের মাধ্যমে নিজের ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করেন খাদিজা। পরে তিনি জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন।

জানা গেছে, বলতলা গ্রামে একসময় রুবেলের পরিবার ছিল মুর্তিমান আতংক। শুধু বলতলা নয়, পাশের ইউনিয়ন আওরাবুনিয়ার ছোট কৈখালী গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায় ও অন্য সব জনগণের সম্পত্তি দিনে দুপুরে গরুছাগল লুট করা, রাতে ডাকাতির অভিযোগ ছিল। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করত না। গেল এক দশকে ওই এলাকার বিভিন্ন বিরোধে একে একে খুন হয়েছিলেন রুবেলের পরিবারের তিন সদস্য, দাদা হাকিম খান, বাবা বারেক খান ও ভাই রাসেল খান। সর্বশেষ খুন হয় ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি রুবেল খান।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যার পর খাদিজার স্বামীসহ জড়িত অন্যরা নানা কৌশলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে খাদিজা যেন শুধু তাকে জড়িয়ে জবানবন্দি দেন। তাকে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে তাকে জামিনে বের করে আনা হবে। এতে বাইরে থেকে জড়িত অন্যরা তাকে জামিন করানোর ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারবে। খাদিজাকে তারা বোঝায় যে নারীদের খুব বড় সাজা হয় না। তবে দিনের পর দিন জেলে বন্দি থাকার পর খাদিজার এক সময় বুঝতে পারে যে কেউ তার খোঁজখবর নিচ্ছে না। একই অপরাধ করে তার স্বামীসহ অন্যরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর তিনি চার দেয়ালের ভেতরে কষ্টে আছেন। এরপরই খাদিজা তার জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করে এলে কাহিনি ফাঁস করার মনস্থির করেন। মামলা মোড় নেয় অন্যদিকে।

খুনের রহস্য বের করতে গিয়ে সিআইডি জানতে পারে যে, রুবেলের জমির বর্গাচাষ করত তার প্রতিবেশী বাবুল হাওলদার। এক দিন বাবুলের একটি ছাগল ধরে নিয়ে জবাই করে খেয়েছিলেন রুবেল খান। বর্গাচাষি বাবুল ছাগল হারিয়ে রুবেলের বিরুদ্ধে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে নালিশ দেন। এতে ক্ষুব্ধ হন রুবেল। বাবুলকে বেদম প্রহার করে রুবেল। এতে বাবুল গুরুত্বর আহত হয়। ছাগল হারানো ও মারধরের ক্ষোভ পুষে রেখে জমির মালিক রুবেলকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন বাবুল ও তার স্ত্রী খাদিজা। এ পরিকল্পনায় তারা যুক্ত করেন এলাকার কয়েকজন দাগি অপরাধীকে, যারা ছিল রুবেলের প্রতিপক্ষ। মূলত রুবেলের পরিবারের অন্য যে তিন সদস্য হত্যার শিকার হয়েছিলেন, সেসব মামলার আসামি। রুবেলের শত্রুপক্ষকে এক করে ঠান্ডা মাথায় মিশন সফল করা হয়। ছাগল হারানো এবং নিজে রুবেলের হাতে পিটুনির ক্ষোভ থেকে বদলা নিতেই হত্যা মিশনে ১৪ জন জড়িয়ে পড়েন।

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, ছাগল হারানো ও তার বিচার চাইতে গিয়ে মার খেয়ে বর্গাচাষি বাবুল তার জমির মালিক রুবেল খানকে শায়েস্তা করার ফাঁদ পাতেন। কে কে রুবেলের ‘শত্রু’ হিসেবে পরিচিত, তাদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করেন। রুবেলের ভাইয়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত নান্না হাওলাদার, সুমন হাওলাদার ও লিটন হাওলাদারের সঙ্গে বৈঠকও করেন বাবুল। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাবুলের স্ত্রী খাদিজাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেন। খাদিজা দিনের পর দিন রুবেলের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের ৯ জানুয়ারি সকালে বাবুল তার জমির মালিক রুবেলকে জানান, কয়েক দিনের জন্য তিনি ঢাকায় চলে যাচ্ছেন। এ সময় জমি দেখাশোনা করবেন তার স্ত্রী খাদিজা। রাত সাড়ে ৮টার দিকে রুবেলকে ফোন করে খাদিজা জানান, বাসায় কেউ নেই। চাইলে রাতে দেখা করতে পারেন। এরপর রাতে খাদিজার বাসায় যান রুবেল খান। তবে ঢাকায় না গিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘরের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন খাদিজার স্বামী বাবুল ও তার সহযোগীরা। রুবেল ঘরে প্রবেশের পর রাতের আঁধারে বারান্দায় বসে খাদিজার সাথে গল্প করছিলেন দু’জন। ওই সময় বাবুল, শাহাদতসহ কয়েকজন রুবেলকে এলোপাতাড়ি দা দিয়ে কোপাতে থাকেন। এরপর খাটের ওপর নিয়ে মুখে কম্বল দিয়ে চাপা দেন তারা। এ সময় টিনের ঘরের ভেতর থেকে গোঙানির শব্দ বাইরে চলে গেলে খাদিজার পাশের ঘরের বাসিন্দা ফাতেমা ও ফরিদা শব্দ পেয়ে এগিয়ে যান। তখন খাদিজার ঘরের পেছনের দরজা নিয়ে বাবুল এবং তার সহযোগীরা সবাই পালিয়ে যান। এ সময় খাদিজা ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখেন। সময় ঘরের ভেতর থেকে খাদিজা বলতে থাকেন তার স্বামী অসুস্থ থাকায় এমন শব্দ বের হচ্ছে। তবে এ কথায় তাদের সন্দেহ হয়। বারবার দরজা খুলতে খাদিজাকে বলা হলে খাদিজা দরজা না খোলায় ফাতেমা তার শ্বশুর সামাদ মাস্টারকে ডেকে আনেন। টর্চ লাইটের মাধ্যমে তারা খাদিজার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে কি ঘটেছে বোঝার চেষ্টা করেন। টর্চ লাইটের আলোতে দেখেন ঘরের মেঝে রক্তে ভিজে গেছে। দ্রুত তারা স্থানীয় চেয়ারম্যান, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ আসলে তখন সবাই দরজা খুলে রক্তাক্ত মৃত অবস্থায় খাটের ওপর রুবেল খানের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন।

জানা গেছে, খাদিজার দেওয়া তথ্য-প্রযুক্তিগত নানা দিক বিশ্লেষণ করে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে রুবেল খান হত্যাকাণ্ডে ১৪ জনের সংশ্লিষ্টতা ছিল। খাদিজা ও তার স্বামী বাবুল ছাড়াও অন্যরা হলেন, নজরুল ইসলাম বাবুল, নাজমুল হাসান, কালাম হাওলাদার, শহীদুল ইসলাম, রাজু, শাহজাহান, মোতালেব, নান্না, সুমন, লিটন, সুলতান মোল্লা ও শাহাদাত।

একাধিক সংস্থার হাত ঘুরে মামলাটির সর্বশেষ তদন্ত ইউনিট ছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। বর্গাচাষি বাবুল ও তার স্ত্রী খাদিজাসহ ১৪ জনকে আসামি করে গত সোমবার ১৫ জানুয়ারি অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি।

মামলাটির সিআইডির পক্ষ থেকে প্রথম তদন্ত করেন পরিদর্শক ফারুক খান। তিনি বর্তমানে বরিশালে কর্মরত রয়েছেন। ফারুক বলেন, রুবেল হত্যায় যারা জড়িত তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে আগে থেকে ৮-১০টি করে মামলা রয়েছে। তারা এলাকায় চিহ্নিত অপরাধী। আবার রুবেল নিজেও নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।

মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক সোলায়মান মাহমুদ বলেন, রুবেল পরিবার এলাকায় ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ হিসেবে পরিচিত। তার পরিবারের চার সদস্য হত্যার শিকার হন। তবে বর্গচাষি বাবুল যেভাবে তার ছাগল খোয়ানো ও মারধরের শিকারের বদলা নিতে রুবেলের পরিবারের আগের শত্রুদের একত্রিত করে হত্যা মিশন সাজিয়েছে, এটা অচিন্তনীয়। এ মামলায় ১৪ আসামির মধ্যে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা গেছে। বাকিরা এখনও পলাতক। বর্গচাষি বাবুল গ্রেপ্তারের পর আদ্যোপান্ত জানিয়ে জবানবন্দি দিয়েছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বিভিন্ন হামলা-নির্যাতনে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করবে ববি ছাত্রদল

বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির আভাস

পাওনা টাকা চাওয়ায় দোকানিকে পিটিয়ে মারল যুবলীগ কর্মী

যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদী

সব জাতিগোষ্ঠীর সমঅধিকার নিশ্চিতে কাজ করে বিএনপি : টুকু

লেভানদোভস্কির হ্যাটট্রিকে বার্সার সহজ জয়

সিলেটে যৌথ বাহিনীর অভিযান, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার

নওগাঁয় সড়ক দুর্ঘটনায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীসহ নিহত ৩

হিন্দুদের পাশে বিএনপির নেতাকর্মীরা ছায়া হয়ে থাকবে : দুলু

শিল্পাঞ্চলে শান্তি ফেরাতে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে : সাইফুল হক

১০

মেয়ের সঙ্গে অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করায় বাবার ওপর হামলা

১১

পাহাড়ি ঢলে হারিয়ে গেল ১৬ বাড়ি

১২

আবাসিক হল ছাত্রলীগমুক্ত করার দাবিতে বিক্ষোভ

১৩

সিভাসু থেকে উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আলটিমেটাম

১৪

ওষুধের মূল্যবৃদ্ধিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উদ্বেগ

১৫

ভারতে পালানোর সময় সাবেক এমপি নারায়ণ চন্দ্র আটক

১৬

চট্টগ্রামের রেলওয়ে শ্রমিক দলের সমাবেশ মঙ্গলবার

১৭

হেসে খেলেই টাইগারদের হারিয়ে দিল ভারত

১৮

শিল্পকলায় নবনিযুক্ত পরিচালকের সঙ্গে মতবিনিময় সভা

১৯

কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির কমিটি বিলুপ্ত

২০
X