জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার সরকারি সাঈদ আলতাফুনেচ্ছা কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জন করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মো. জান্নাতুল ফেরদৌস রনিকে মারধরের অভিযোগ তুলে এর প্রতিবাদ এবং বিচার দাবিতে এ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।রোববার (১৪ জানুয়ারি) কলেজে গিয়ে দেখা যায় পূর্বের ঘোষণানুযায়ী তারা ক্লাস বর্জন করেছেন। কলেজ ক্যাম্পাসে এ সংক্রান্ত একটি ব্যানারও টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা কলেজে এসে ক্লাস না হওয়ায় বাড়ি ফিরছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (১১ জানুয়ারি) ক্ষেতলাল উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মেহেদী আশিক রাজু ও যুগ্ম আহ্বায়ক জুল আরশ শুভর বিরুদ্ধে দলবল নিয়ে ক্ষেতলাল সরকারি সাঈদ আলতাফুনেচ্ছা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস রনিকে (৩২) মারধর করার অভিযোগ ওঠে। পরে এর বিচার চেয়ে থানায় মামলা হয়।
জানা গেছে, ওই দিন দুপুর আড়াইটায় কলেজ সড়কের মৎস্য খামারের সামনে জান্নাতুল ফেরদৌস রনিকে মারধর করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিকেল সাড়ে ৩টায় ওই কলেজের শিক্ষকরা ক্ষেতলাল থানার সামনে মানববন্ধন করেন। এরপর অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা করেন মারধরের শিকার ওই শিক্ষক। এ সময় কলেজের অন্য শিক্ষকরা তার সঙ্গে ছিলেন।
মানববন্ধন থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও সুষ্ঠু বিচার না হলে আজ রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বর্জন করা হবে।
কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ছাত্র কালবেলাকে বলেন, আমরা কলেজে এসে জানতে পারি গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের নেতারা আমাদের কলেজের এক শিক্ষককে মারধর করেছে। এর প্রতিবাদে স্যাররা ক্লাজ বর্জন করেছেন। এ জন্য আমরা ক্লাস করতে না পেরে বাড়ি ফিরছি।
প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস রনি ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের নশিরপুর গ্রামের আব্দুর রশিদ মন্ডলের ছেলে। তিনি ক্ষেতলাল উপজেলা বিএনপির সভাপতি খালেদুল মাসুদ আঞ্জুমানের ভাগিনা বলে জানা গেছে।
গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস রনি লোকজনদের ভোটকেন্দ্রে আসতে বাধা দিয়েছেন এমন অভিযোগ তুলে উপজেলা ছাত্রলীগ নেতারা তাকে মারধর করেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস সকালে কলেজে আসেন। উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মেহেদী আশিক রাজু ও যুগ্ম আহ্বায়ক জুল আরশ কলেজে গিয়ে প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস রনিকে খোঁজাখুঁজি করে চলে যান। প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস রনি দুপুরে খাবারের জন্য বাজারে আসছিলেন। তিনি দুপুর আড়াইটার দিকে কলেজ সড়কের মৎস্য খামারের কাছে পৌঁছান। এ সময় ক্ষেতলাল উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মেহেদী আশিক রাজু ও যুগ্ম আহ্বায়ক জুল আরশ শুভ দলবল নিয়ে সেখানে প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস রনিকে মারধর শুরু করেন। কলেজের অন্য শিক্ষকরা এগিয়ে এসে তাকে অভিযুক্তদের কবল থেকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনা জানাজানির পর কলেজের অন্য শিক্ষকরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। প্রতিবাদে বিকেল সাড়ে ৩টায় কলেজের শিক্ষকরা থানার সামনে মানববন্ধন করেন। ওই মানববন্ধন থেকে শিক্ষকরা অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানান। অন্যথায় রোববার থেকে কলেজের পাঠদান বর্জনের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।
খবর পেয়ে ওই দিন বিকেলেই জয়পুরহাট সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইশতিয়াক আলম ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি মারধরের শিকার শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রভাষক জান্নাতুল ফেরদৌস রনি কালবেলাকে বলেন, আমি কলেজ থেকে বের হয়ে দুপুরে ক্ষেতলাল বাজারে লাঞ্চ করতে যাচ্ছিলাম। কলেজ সড়কের সরকারি মৎস্য খামারের সামনে পৌঁছালে যুগ্ম আহ্বায়ক জুল আরশ শুভ আমাকে ডেকে বলে আপনার সঙ্গে কথা আছে। দুই মিনিট পর দেখি ছাত্রলীগের আহ্বায়ক রাজু তার সঙ্গে ১৫-২০ জন ছেলে লাঠিসোঁটা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। এসেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে এবং আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাঠিপেটা করেন। এ সময় আমার চিৎকারের সহকর্মীরা এগিয়ে এসে আমাকে তাদের কবল থেকে উদ্ধার করে ক্ষেতলাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। চিকিৎসা শেষে বিকেলে ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়েছি। তিনি ভোটকেন্দ্রে আসতে কাউকে বাধা দেননি বলে দাবি করেন।
ক্ষেতলাল সরকারি সাঈদ আলতাফুন্নেছা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জিনাত রেহানা কালবেলাকে বলেন, আমি আমার প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। আমার একজন শিক্ষককে দিন-দুপুরে রাস্তায় প্রহার ও লাঞ্চিত করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে আমরা ক্লাস বর্জন করেছি।
এ বিষয়ে জানতে ক্ষেতলাল উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মেহেদী আশিক রাজুর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি যুগ্ম আহ্বায়ক শুভর সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জুল আরশ শুভ কালবেলাকে বলেন, ওই শিক্ষক নির্বাচনের আগে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করেছিল। জাতীয় কোনো দিবসে তিনি কলেজে উপস্থিত থাকেন না। এমনকি শোক দিবসের দিন তিনি ব্যাচ ছিড়ে ফেলেছিলেন। ঘটনার সময় আমরা কয়জন কলেজ সড়কে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওই শিক্ষক রাস্তা দিয়ে আসার সময় আমাদের একজন ছেলে তাকে বলেন, স্যার আপনি না কি ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসতে নিষেধ করেছিলেন? তখন ওই শিক্ষক ছেলেপেলের ওপর চড়াও হয়ে নেত্রীকে গালাগাল করেন। ছেলেরা প্রতিবাদ করলে একজনকে তিনি ধাক্কা দেন। তখন ছেলেরা উত্তেজিত হন। আমি আর আহ্বায়ক রাজু তাদের শান্ত করে স্যারকে পাঠিয়ে দিই। তাকে আমরা মারধর করিনি।
এদিকে ওই শিক্ষককে মারধরের ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ক্ষেতলাল থানায় মামলা হলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
এ বিষয়ে ক্ষেতলাল অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আনোয়ার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ঘটনার দিন বিকেলেই ওই শিক্ষক থানায় একটি এজাহার দিলে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সেটি মামলা হিসেবে রের্কড করি। এখন পর্যন্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারিনি। তবে তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।
মন্তব্য করুন