গজারিয়া (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:২৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

অন্ধকার সেতুতে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব পথচারী

মেঘনা সেতুতে জ্বলছে না ল্যাম্পপোস্টের আলো। ছবি : কালবেলা
মেঘনা সেতুতে জ্বলছে না ল্যাম্পপোস্টের আলো। ছবি : কালবেলা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক জাতীয় অর্থনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। আর এ মহাসড়ক নিরাপদ রাখার দাবি গাড়িচালক ও মালিকরা প্রতিনিয়তই জানিয়ে আসছে। এ মহাসড়কের মেঘনা সেতু গুরুত্বপূর্ণ হলেও গত কয়েক মাস ধরে সেতুর ল্যাম্প পোস্টে আলো না জ্বলায়, প্রায়ই ছোট-বড় ছিনতাইয়ের কবলে পড়ছেন এ পথে চলাচলকারী যানবাহন চালক ও পথচারী। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলাকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সাথে মেলবন্ধন করেছে গুরুত্বপূর্ণ এই মেঘনা সেতু। বলা হয়ে থাকে দেশের বস্ততম এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। গত কয়েক মাস যাবত সেতুর ল্যাম্প পোস্টে আলো না থাকায় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে যানবাহন চালক ও পথচারীদের। সেতুর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও অংশে দেশের স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানি থাকায় সেখানে চাকরিরত অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া অংশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাস করেন। তাদের কাজকর্ম শেষে এই সেতু দিয়ে পারাপার হতে হয়। আর নিরাপত্তা বাহিনী ও রাতে সেতুর ল্যাম্প পোস্টে আলো না থাকায় প্রতিনিয়তই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়তে হয় তাদের। তাছাড়া দূরপাল্লার যানবাহন বিশেষ করে ট্রাকচালকদের গাড়ি গতিরোধ করে ছিনতাইকারীর কবলে পরার খবর পাওয়া যায় প্রায়ই। এ ছাড়া অন্ধকারে সেতু এলাকায় চুরি হয়ে যাচ্ছে সেতুর মূল্যবান মালামাল। সরকার এত টাকা দিয়া সেতু তৈরি করছে আর নিরাপত্তা বাহিনী এবং ল্যাম্পপোস্টগুলোতে আলো না থাকায় মানুষের জানমাল হুমকির মুখে এবং সেতুটির গুরুত্বপূর্ণ মালামাল চুরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। চোর চক্রের অপতৎপরতা রোধ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে আনসার নিয়োগ দেওয়ার চিন্তা করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। তবে বরাদ্দের অভাবে এই পরিকল্পনাটিও ভেস্তে যেতে পারে।

স্থানীয়রা জানায়, গত কয়েক মাসে এই এলাকায় বেড়েছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। আর সেতুর মালামাল চুরি করতে গড়ে উঠেছে সঙ্ঘবদ্ধ একটি চক্র। তানভির ও তার বন্ধু মেঘনাঘাটের দেশের সনামধন্য একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। তাদের ডিউটি শেষ হতে হতে প্রায় রাত হয়ে যেত, অনেক সময় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেও বাস পাওয়া যেত না। সেজন্য প্রায় রাতে অফিস ছুটির পর মেঘনা সেতু হেঁটে পার হয়ে গজারিয়ার জামালদী স্ট্যান্ডে আসতে হয়। প্রায় সময় সেতুর ওপরে এবং এর নিচের অংশে অনেকে ছিনতাকারীদের কবলে পরে। বিশেষ করে ঈদ, পূজা এবং মাসের প্রথমে যখন কোম্পানিগুলো থেকে শ্রমিকদের বেতন দেবার সময় হয়। তিনি আরও জানান, কিছুদিন আগে এক রাতে সে সহ তার সহকর্মীরা সেতুর ওপর দিয়ে পার হচ্ছিরেন। হঠাৎ তাদের পিছনে থাকা বন্ধুকে সেতুতে আগে থেকেই বসে থাকা তিন চারজন সঙ্ঘবদ্ধ ছিনতাইকারী ছুরি ঠেকিয়ে তার পাওয়া বেতনের টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনতাই করে নিয়ে যায়।

আল আমিন এবং হোসেন একই পরিবারের আপন দুই ভাই, তারাও চাকরির সুবাদে সেতুর ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। রাতে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীরা তাদের ধাওয়া করলে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করে। পরে তারা জামালদী বাসস্ট্যান্ডে লোকজনকে জানালে সেখান থেকে মানুষজন সেতু ওপরে ছিনতাইকারীদের ধরতে গেলে জনতার উপস্থিতি দেখে মোটরসাইকেলযোগে চক্রটি পালিয়ে যায়। তবে এ ঘটনার পরের দিন তারা দুই ভাই জানতে পারে, ওই রাতেই তাদের সাথে কাজ করা এক বন্ধুর মোবাইল ফোন ছিনতাই করেছে, আবার তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করতে চেয়েছে। এ ঘটনার পর জীবনের নিরাপত্তা না থাকায় তারা দুই ভাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।

সাইদুল নামে অপর আরেকজন জানায়, তারা প্রতিনিয়ত এ দিক দিয়ে যাতায়াত করে। তবে হঠাৎ বিভিন্ন কারণে গাড়ি না পেলে সে দিন মৃত্যুকে হাতে নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয় মেঘনা সেতুর ওপর দিয়ে প্রায় শোনা যায় এখানে ছিনতাই হয়। এত বড় ব্রিজ এখানে নেই রাতের বেলা কোনো পুলিশ, সেতুর লাইটগুলোতে নেই আলো আর এই সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকরারী চক্র অপকর্ম করে যাচ্ছে। তাছাড়া ব্রিজের বিভিন্ন অংশের নাট-বল্টু চুরিসহ মূল্যবান মালামাল চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে তবে দেখার কেউ নেই।

সরেজমিনে সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সব ল্যাম্প পোস্টই দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু কোনোটিতেই আলো জ্বলছে না। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে গোটা এলাকা। হেডলাইটের আলোয় চলাচল করছে যানবাহন, অন্ধকারেই হেঁটে সেতু পার হচ্ছেন কয়েকজন মানুষ। সেতুর নিচের গজারিয়া অংশের বিস্তীর্ণ এলাকায় দেখা যায়, মানুষের ছোট-বড় জটলা। কেউ বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন, কেউ আবার একসাথে মিলে সিগারেট, গাঁজাসহ বিভিন্ন রকম মাদক সেবন করছেন। তবে এ সময় সেতু এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে কোনো বাহিনীকেই দেখা যায়নি।

তাছাড়া একাধিক যানবাহন চালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাতে সেতুটিতে আলো না থাকায় ওঁৎ পেতে থাকা এই চোর-ছিনতাইকারী চক্রটি গাড়ির গ্লাসে ঢিল মেরে মাঝেমাঝে হুমকি-ধমকি দিয়ে গাড়ির গতিরোধ করে মোবাইল, টাকা-পয়সাসহ অন্য মূলবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়। বিষয়টি সম্পর্কে তারা আরও বলেন, গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়েই চলাচল করি। তারপরও সেতুতে পর্যাপ্ত আলো থাকা দরকার ছিল। সরকার হাজার কোটি টাকা খরচ করে এত সুন্দর একটি স্থাপনা তৈরি করেছে সেখানে আলো থাকবে না বিষয়টি দুঃখজনক।

১নং হোসেন্দী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়্যারম্যান মনিরুল হক মিঠু বিষয়টি সম্পর্কে বলেন, সেতুর সিঁড়ির লোহা, নাট বল্টু, পাইপ চুরি করাসহ পথচারীরা ছিনতাইকারীর কবলে পরা বিষয়টি আমি শুনেছি। নিরাপত্তার ব্যাপারটি তো ইউনিয়ন পরিষদের দেখার কথা নয়। তবে বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে আলোচনা করব যেন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।

বিষয়টি সম্পর্কে নারায়ণগঞ্জ সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস কালবেলাকে বলেন, নতুন সেতু যখন তৈরি করা হয় তখন অনেক দামি তার লাগানো হয়েছিল কিন্তু 'মেঘনা এবং গোমতী সেতুকে কেন্দ্র করে সঙ্ঘবদ্ধ একটি চোরচক্র গড়ে উঠায় সব চুরি করে নিয়ে গেছে কোনোভাবেই যেন এই চক্রটির হাত থেকে সেতুর গুরুত্বপূর্ণ মালামাল রক্ষা করতে পারছি না। তবে আমাদের বরাদ্দ কম থাকায় পুনরায় আমরা পুরোপুরি ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বালাতে পারছি না। আমার ঊর্ধ্বতন র্কমকর্তাকে জানানো হয়েছে বরাদ্দ পেলেই আলো জ্বালানোর কাজ করব। আর সেতুর নিরাপত্তার বিষয়াটি দেখার জন্য এত জনবল (সওজ) নেই। তবে নিরাপত্তার বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। তাদেরও জনবল সংকট। এরই মধ্যে মুন্সীগঞ্জ আনসার কমান্ডারের কাছে জনবল চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। তিনি বড় একটি ডিমান্ট দিয়েছেন যেখানে আনসারদের থাকা খাওয়াসহ অন্য বিষয়গুলো সওজকে দেখতে হবে। বিষয়টি নিয়ে আমি প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে আলাপ করেছি। চোর ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে ফাইনাল একটি সমাধানের চেষ্টার প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিরাপত্তার বিষয়ে ভবেরচর হাইওয়ে পুলিশ ফাড়ির ইনর্চাজ হুমায়ন কবির (পিপিএম) জানান, আমরা সব সময় রাস্তায় থাকি জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য। আমাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। তবে সড়ক ও জনপদ বিভাগ যদি নতুন কোনো রোডম্যাপ তৈরি করে হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের সর্বোচ্চ সাহায্য করব।

উল্লেখ্য, যানবাহনের অত্যধিক চাপে চার লেনের দ্বিতীয় মেঘনা সেতু নির্মান করা হয়। আর এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭৫০ কোটি টাকা। ১২টি স্প্যানের ওপর নির্মিত দ্বিতীয় মেঘনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯৩০ মিটার, ১৭.৭৫ মিটার প্রস্থ। আর এ সেতুতে মানুষ চলাচলের জন্য দেড় মিটার ফুটপাত রাখা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই লেনের সেতুর কারণে যানজটের সৃষ্টি হওয়ায় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় মেঘনা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করে সরকার। ২০২০ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের সাত মাস আগে ২০১৯ সালের ২৫ মে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেতুটি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেবে সেভ দ্য চিলড্রেন

চাঁদ জয়ের প্রস্তুতি নিতে শিশুদের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

৬ষ্ঠ দিনেও আন্দোলনে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

টিউলিপ কী মন্ত্রী হচ্ছেন?

বন্যা নিয়ে দুঃসংবাদ দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীর

জিম্মিদের মুক্তিতে মার্কিন প্রস্তাবে সম্মত ফিলিস্তিনিরা

নিজ এলাকায় চিকিৎসা নিতে এমপিদের অনুরোধ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর

দেশের প্রথম আইন বিশ্ববিদ্যালয় হবে শিবচরে : আইনমন্ত্রী

তাঁতীবাজার সড়ক অবরোধ / গান-কবিতায় বেগবান হচ্ছে জবি শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন

প্রথম কার্য দিবসে কী করবেন যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী?

১০

এসিআইয়ে অভিজ্ঞতা ছাড়া চাকরি, আছে বিদেশ ভ্রমণের সুবিধা

১১

বাবাকে খুঁজে পেতে নড়াইলের তরুণী পাবনায়

১২

এবার বেনজীরের ডুপ্লেক্স বাড়ি জব্দ

১৩

লিপি মনোয়ারকে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের স্বর্ণপদক প্রদান

১৪

নৌকাডুবে প্রাণ গেল দুই বন্ধুর

১৫

১৩০০ বছর আগের ঐতিহাসিক ‘জাদুর’ তলোয়ার উধাও!

১৬

সুপার স্পেশালাইজডের বিদ্যমান আইনে নতুন সংযোজন প্রয়োজন : বিএসএমএমইউ উপাচার্য

১৭

ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে ঢাবিতে কোটাবিরোধী বিক্ষোভ শুরু

১৮

এশিয়া কাপের আম্পায়ারিং প্যানেলে জেসি

১৯

যে কারণে ইয়ামালকে পুরো ম্যাচ খেলাচ্ছে না স্পেন?

২০
X