হাদিউল হৃদয়, তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৪০ এএম
অনলাইন সংস্করণ

আশার আলো দেখছেন না চলনবিলের শুঁটকি ব্যবসায়ীরা

মাছের অভাবে ফাঁকা পড়ে আছে মহিষলুটি এলাকার কয়েকটি চাতাল। ছবি : কালবেলা
মাছের অভাবে ফাঁকা পড়ে আছে মহিষলুটি এলাকার কয়েকটি চাতাল। ছবি : কালবেলা

দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিলে সাম্প্রতিক সময়ে মাছের অভাবের কারণেই শুঁটকির চাহিদা ও উৎপাদন ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ফলে ঐতিহ্যবাহী দেশীয়ও মাছের শুঁটকির ভবিষ্যৎ এখন অন্ধকারের পথে। এ দিকে এ অঞ্চলে সংরক্ষণাগার থাকলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো সম্ভব বলে দাবি করছেন স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, চার দশক পূর্বে ৮০ দশকে চলনবিলের মাছের রমরমা শুঁটকির ব্যবসা শুরু হয়। আশ্বিনের শুরুতে তাড়াশ, উল্লাপাড়া, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, ফরিদপুর, গুরুদাসপুর, সিংড়া এবং আত্রাই উপজেলা এলাকার বিলে অস্থায়ী আবাস গড়ে ব্যবসায়িরা শুঁটকির চাতাল বিছিয়ে শুঁটকি তৈরি করতেন। মাছ প্রাপ্তি সাপেক্ষে তা পৌষ মাস পর্যন্ত চলতো। পুঁটি, টাকি, ট্যাংড়া, খলিশা, চান্দা, বোয়াল, ঘুচি, ইচা বা ছোট চিংড়িসহ নানা প্রকারের বিষমুক্ত দেশীয়ও মাছের শুঁটকি তৈরি হতো শত শত টন। যা উওরের মোকাম সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতেন। আবার চলনবিলের শুঁটকি সৈয়দপুরের মহাজনদের হাত বদলে ভারতে রপ্তানি করা হতো। দেশে আসত বৈদেশিক মুদ্রা।

চলনবিলের হাট-বাজারে ঘুরে জানা যায়, শুঁটকি করার মতো পুঁটি মাছ প্রতি কেজি প্রকার ভেদে ৩৫ থেকে ১৬০। টাকি ১৪০ থেকে ১৫৫। খলিশা ৫৫ থেকে ৮৫। চান্দা ৬৫ থেকে ৭৫। ট্যাংড়া ২৭০ থেকে ৩৩০ টাকায় চাতাল মালিকরা কিনছেন। যা গত বছরের চেয়ে বেশি। পাশাপাশি শুঁটকির উপযোগী পর্যাপ্ত বোয়াল, শোল, গচি, ইছা মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এ মৌসুমে প্রতি মণ পুঁটির শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ হাজার, টাকি ২৫ থেকে ৩৫, বোয়াল ৩২ থেকে ৩৬, খলিশা ১৬ থেকে ১৮ হাজার, চান্দা ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকায়। কিন্তু ওই সকল মোকামে শুঁটকির চাহিদা থাকলেও চলনবিলের ব্যবসায়ীরা সরবরাহ করতে পারছেন না।

মহিষলুটি চাতালের ব্যবসায়ী নাটোর জেলার গুরুদাসপুর এলাকার নান্নু মিয়া জানান, চাতালে শুঁটকিতে মাছি বসা রোধ, ওজন ঠিক রাখতে মাছ চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লবন পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে তা ধুয়ে প্রয়োজন মতো রোদে শুকিয়ে নিরাপদ শুঁটকি তৈরি হয়। চলনবিলের শুঁটকিতে কোনো ক্ষতিকারক কেমিক্যাল মেশানো হয়না। এতে মানুষের শরীর স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না। এ কারণে যে কোনো মোকামে চলনবিলের মাছের শুঁটকির কদর ও দাম রয়েছে।

সিংড়া মাছ বাজারের ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বলেন, চলনবিলে চেলা, টাকি, শোল, পাতাসি, চান্দা, পুঁটি, টেংরা, গজার, মাগুর, কই, চিংড়ি, রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছের বিচরণ বেশি। বর্ষায় প্রচুর মাছ বংশ বিস্তার করে বিলের পানিতে। বর্ষাকালে এসব মাছ খুব কমই ধরা পড়ে। তবে অক্টোবর মাস থেকে বিলের পানি নামতে শুরু করলে মাছ ধরার পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে গেলেও এবার মাছের পরিমাণ খুবই। আবার যেটুকুই পরিমাণ কাঁচা মাছ পাওয়া যায়। তা একসঙ্গে বাজারজাত করা সম্ভব হয় না। এ সময় ধরা পড়া মাছের একটি অংশ শুঁটকি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করেন। তবে এই অঞ্চলে মাছ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ জন্য তারা সারা বছর শুঁটকি উৎপাদনের সুযোগ পাচ্ছেন না।

শুঁটকি ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের শুঁটকির মান ভালো। বিক্রিও ভালো। কিন্তু সারা বছর আমরা শুঁটকি উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারি না। কারণ, এখানে মাছ সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা নাই।

তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি এলাকায় শুঁটকির চাতালের শ্রমিক ফাতেমা খাতুন বলেন, এ মৌসুমে শুঁটকি তৈরিতে এলাকার প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ নারী-পুরুষ কাজ করতেন। এখন মাছের অভাবে শুঁটকির উৎপাদন কম হওয়ায়। এখন কাজ কম হওয়ায় পারিশ্রমিকও কম। আবার আমরা আগে নারী শ্রমিকরা ৩৫০ থেকে ৩০০ টাকা পেতাম। পুরুষের সাড়ে ৫০০ থেকে ৪৫০ টাকা। অথচ কাজ করার আগ্রহী শ্রমিক বেশি হওয়ায় নারীদের ২৫০ এবং পুরুষদের ৪০০ টাকা দিন হাজিরা দেওয়া হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার বিনায়েকপুর গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল গফুর জানান, দীর্ঘ ২০ বছর হলো চাতালে শুঁটকির ব্যবসায় করে আসছি। আমার এ শুঁটকির চাতালে প্রায় চার মাস ১২-১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। গত ২০২১ সালে ৩৫ লাখ টাকার মাছ কিনে প্রায় ৫৫০ মন শুঁটকি পেয়েছিলেন। ২০২২ সালে টাকা থাকলেও চাহিদা মত মাছ পাননি। তাই ২৮ লাখ টাকায় মাছ কিনে ৪৭০ মণ শুঁটকি তৈরি করেন। গত আট থেকে ১০ বছরে শুঁটকি তৈরির মৌসুমে উপযোগী মাছের স্বল্পতায় এ অঞ্চলে শুঁটকির চাতাল কমার সাথে রোজগারে টান পড়েছে। এ বছর মৌসুমের শুরুতেই শুঁটকি করার মত চাহিদা মাফিক মাছ পাচ্ছেন না। তাই অর্ধেক চাতালে মাছ শুকালেও আর অর্ধেক ফাঁকা পড়ে আছে।

তবে তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মসগুল আজাদ বলেন, এ বছর তাড়াশ উপজেলায় মহিষলুটি মৎস্য আড়তের ৫টি চাতালে ১৪৮ টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে মৎস্য বিভাগ। তাড়াশের কুন্দাইল, নওগাঁ, ধামাইচহাট, সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলা, নাটোরের চলনবিল এবং ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গাসহ বিভিন্ন জেলার ৩০ থেকে ৪০টি বিল থেকে কাঁচা মাছ সংগ্রহ করে এখানকার চাতালে সরবরাহ করা হয়। শুঁটকি তৈরিতে কোনো রকম রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার হয় না। মানভেদে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডে বাছাই করা হয়। পাঠানো হয় ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে। ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে সেখান থেকে ভালো মানের শুঁটকি রপ্তানি করা হয় বিভিন্ন দেশে।

এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান বলেন, শুঁটকি তৈরির সাথে জড়িতদের নিরাপদ শুঁটকি তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। পাশাপাশি শুঁটকির উৎপাদন বাড়াতে তাঁদেরকে উব্ধুদ্ধ করা হয়। আর গত বছর তাড়াশে শুঁটকি উৎপাদন কম হলেও উল্লাপাড়া উপজেলায় বেশি ছিল। আর এখন মাছের দামও বেশি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১০

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১১

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১২

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৩

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৪

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৫

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৬

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৭

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

১৮

‘এক ফ্যাসিস্টকে হটিয়ে আরেক ফ্যাসিস্টকে ক্ষমতায় দেখতে চাই না’

১৯

জুলাই বিপ্লবে আহত মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বাবুকে নেওয়া হচ্ছে থাইল্যান্ড

২০
X