‘আধুনিক যুগের ঝনঝনানি শুনি ব্যান্ডের গান, গাইতে শুনতে নাচা পরে জিনে দইজ্জি পান।’ লোকসংগীত, যাত্রাপালা, নাট্য ও পালাগান ছিল বাংলার ঐতিহ্য। এসব অনুষ্ঠানকে মনোমগ্ধকর করে তুলতে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়াম, তবলা, ঢোল, ঢুকঢুকি,বাঁশি ও একতারা-দোতারার মতো দেশীয় বাদ্যযন্ত্র গুলো শোভা পেত বাংলার গ্রামান্তরে। কিন্তু আধুনিক ও পাশ্চাত্য সংগীত আর ইলেকট্রনিকের বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবে দেশীয় এসব বাদ্যযন্ত্র ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসলেও হার মানতে নারাজ উজ্জল সিংহ (৪১)। চট্টগ্রামের আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নের বন্দর সেন্টারে ‘নিলয় মিউজিক্যাল হাউস’ নামে দোকান বসিয়ে ২৬ বছর ধরে এসব দেশীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরীর কাজ করছে উজ্জল সিংহ। রয়েছেন চারজন কর্মচারীও।
উজ্জ্বল সিংহের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, চারজন কারিগর সকাল থেকে দিনরাত কাজ করছেন। কেউ হারমোনিয়াম, কেউ তবলা, কেউ ঢোল তৈরি করছেন।
জানা যায়, ১০ থেকে ১৫ বছর আগের হারমোনিয়াম ও তবলার বিক্রি ছিল বেশি। তখন প্রতিদিনই কাজের অর্ডার থাকত। অর্ডার দিয়ে বাদ্যযন্ত্র কিনতেন ক্রেতারা। কিন্তু বর্তমান যুগে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের অধিকাংশই মুখ থুবড়ে পড়েছে ইলেকট্রনিক গিটার, কিবোর্ড, পিয়ানো, ড্রামসেট, ভায়োলিনের মতো ভিনদেশি বাদ্যযন্ত্রের কাছে। যার ফলে এই শিল্প অনেক কমে গেছে। তাই জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেক কারিগর বেছে নিয়েছে অন্য পেশা।
সংগীতের সংকটাপন্ন সময়েও উজ্জ্বল সিংহ দোকানে চার কারিগর টিটু দে, উজ্জল দে, এরশাদ ও হোসেনকে নিয়ে নিলয় মিউজিক্যাল হাউস নামের একটি প্রতিষ্ঠান দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে এই শিল্পকে ধরে রাখার চেষ্টা। উজ্জ্বলের দোকানে হারমোনিয়াম ছাড়াও বাঁশি, একতারা, তবলা, ঢোল, জিসি, ঢোমলো, ঢুক ঢুকি তৈরি করা হয়। একটি হারমোনিয়াম তৈরিতে সময় লাগে একজন কারিগরের এক সপ্তাহ পর্যন্ত। প্রতিটি হারমোনিয়াম তৈরিতে খরচ পড়ে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা আর বিক্রি হয় সাড়ে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া বাঁশি ১৮০ থেকে ৩০০ টাকা, একতারা ২৫০ থেকে ১৫০০ টাকা, ঢোল ২৫০০ থেকে ৮ হাজার, তবলা ৫৫০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।
নিলয় মিউজিক্যাল হাউসের প্রোপাইটর উজ্জ্বল সিংহ সুরের সঙ্গে বলেন, আধুনিক যুগের ঝনঝনানি,শুনি ব্যান্ডের গান, গাইতে শুনতে নাচা পরে জিনে দইজ্জি পান। সংগীত হচ্ছে আত্মার যোগ। সংগীতের মধ্য দিয়ে মনের পরিশুদ্ধি মেলে। সংগীত সাধনার পূর্বশর্ত হচ্ছে অনুশীলন। সেই অনুশীলনের জন্য প্রয়োজন বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু আধুনিক যুগে ইলেকট্রনিকস যন্ত্রের প্রভাবে বাংলার ঐতিহ্য বাদ্যযন্ত্রগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
তারপরও আমি ধরে রাখার চেষ্ঠা করছি। ২৬ বছর ধরে এই কাজ করে যাচ্ছি। সাথে দোকানে চারজন কারিগরও রেখেছি। আনোয়ারা ও কর্ণফুলীতে শুধু আমিই এ কাজ করে যাচ্ছি। বাকিরা সবাই চলে গেছে। এখন আমাকে কর্মচারীদের বেতন দিতে হয় প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা করে। কিন্তু পরিবারের ৭ সদস্য নিয়ে সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। করোনাকালীন সময় থেকে ২৬ বছরে এ পর্যন্ত সরকার কিংবা কোনো সংস্থা আমাকে সহযোগিতা করেনি।
আনোয়ারার সাংস্কৃতিক কর্মীরা উৎপল সেন বলেন, যথাযথভাবে সংরক্ষণের অভাবে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার আজ বিলীনের পথে। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা মো. ইশতিয়াক ইমন বলেন, দেশীয় বাদ্যযন্ত্র আমাদের ঐতিহ্য, উপজেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এখনো দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে থাকি। যারা এ শিল্পে কাজ করছে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্ঠা করব।
মন্তব্য করুন