হরিণাকুন্ডুতে পুলিশের সোর্স পরিচয়ে দিনের পর দিন নানা অপকর্ম করে চলেছেন ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি। নীরিহ মানুষ গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, বিনা দোষে গ্রেপ্তার করানো, বিভিন্ন কাজে এসপি, এএসপির তদবির পাইয়ে দেওয়ার জন্য তাদেরকে ঘুষ প্রদানের কথা বলে টাকা নেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে পুলিশের এই সোর্সের বিরুদ্ধে।
তার অত্যাচারে হরিণাকুন্ডুর বিভিন্ন এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ থাকলেও বর্তমান সার্কেল এসপি অমিত কুমার বর্মনের সঙ্গে তার 'বিশেষ সম্পর্ক' থাকায় তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেন না। দু একজন বিভিন্ন সময়ে মুখ খুললেও তাদেরকে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে বলে জানা যায়। সার্কেল এসপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে থানাতেও তার রয়েছে বিশেষ কদর।
জানা গেছে, উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা গতকাল সোমবার (২ অক্টোবর) সার্কেল এসপির নাম ভাঙিয়ে প্রতারণা করে ৪ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগে ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলা দায়েরের পরেও ইকবাল হোসেনকে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে দেখা গেলেও তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের কোন তৎপরতা না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন উপজেলার শিক্ষক-জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
জানা যায়, উপজেলার ভায়না ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের মৃত শফি সাহার পুত্র ইকবাল হোসেন। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করছেন বলে একাধিক বিশ্বস্থ সূত্র থেকে জানা গেছে। সোর্স হিসেবে জেলার বিভিন্ন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক থাকলেও সহকারী পুলিশ সুপার অমিত কুমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। এই সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে হরিণাকুন্ডুর বিভিন্ন এলাকা দাপিয়ে বেড়ান তিনি। তিনি কখনো এসপি, কখনো সার্কেল এসপি, ডিবির ওসি আবার কখনো থানার ওসির নাম ভাঙিয়ে উপজেলার বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে নিকট থেকে বিভিন্ন অজুহাতে নিয়মিতভাবে মোটা অংকের অর্থ আদায় করে আসছেন। তিনি সবচেয়ে বেশী নাম ভাঙিয়েছেন সহকারী পুলিশ সুপার (শৈলকূপা সার্কেল) অমিত কুমার বর্মনের। তার সঙ্গে ইকবাল হোসেনের সুসম্পর্ক থাকায় বিভিন্ন তদবিরের জন্য ইকবালের হাতে বিশ্বাস করে অনেকেই টাকা তুলে দিয়েছেন।
উপজেলার বাকচুয়া-লক্ষ্মীপুর গ্রামের মিন্টু মালিতা, সিরাজুল ইসলাম, আকুল মালিতা, সোহরাব হোসেন, মালিপাড়া গ্রামের সেলিম রেজাসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৫০ জনের নিকট থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (শৈলকূপা সার্কেল) অমিত কুমার বর্মনের তদবির পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি জুয়া খেলার অনুমতি পাইয়ে দিতে সার্কেল এসপিকে ম্যানেজের জন্য ঘুষ দেওয়ার কথা বলে উপজেলা মোড়ের লিটন আলীর নিকট থেকে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা নেন। ঐ টাকা তিনি সার্কেল এসপিকে ঘুষ দিয়েছেন বলে প্রকাশ্যে তাকে বলে বেড়াতে দেখা যায়। কাজ না হওয়ায় লিটন আলীসহ স্থানীয় জনতা সোর্স ইকবালকে আটক করে টাকা ফেরত নেন।
জানা যায়, সার্কেল এসপি অমিত কুমারের কথা বলে সাধারণ মানুষকে ভয় ভীতি দেখিয়ে-বোকা বানিয়ে তাদের নিকট থেকে বিভিন্ন কায়দায় টাকা আদায় করে আসছেন ইকবাল হোসেন। ইকবাল হোসেনের খপ্পরে পড়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে ইকবালের চাহিদামতো টাকা যোগাড় করতে গিয়ে অনেকেই গরু-ছাগল ও জায়গা জমি বিক্রি করেছেন। অনেকেই নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ইকবালের হাতে তুল দিয়েছেন বলো জানা গেছে।
অন্যদিকে প্রতারণার মাধ্যমে ইকবাল লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছেন। বিভিন্ন এলাকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিনা দোষে মামলা দিয়ে ফাসানোরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। লক্ষ্মীপুর গ্রামের আ.লীগ কর্মী জয়নাল মাস্টার, আনোয়ার হোসেন, মোকাউলসহ অন্তত ১০ জন কর্মীকে ইকবাল বিনা দোষে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করেছেন বলে জানা যায়। ইকবাল তার নিজ গ্রাম লক্ষ্মীপুরের সাধারণ মানুষদেরও পুলিশ দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করান বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী। তথ্য সংগ্রহকালে ইকবালের অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক ভুক্তভোগী এই প্রতিবেদকের নিকট আকুতি মিনতি করেছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হরিণাকুন্ডুর বিভিন্ন ইউনিয়নের একাধিক জনপ্রতিনিধি ইকবালের বিষয়ে বলেন, ইকবাল হরিনাকুন্ডুর সাধারণ মানুষের সীমাহীন ক্ষতি করেছে। মিথ্যা মামলায় ফাসানো, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, মানুষকে বিপদে ফেলে সার্কেল এসপির তদবিরের জন্য ঘুষ প্রদানের কথা বলে টাকা নেওয়াসহ বিভিন্নভাবে সে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি করেছে। প্রশাসনের কথা বলে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে সোর্স ইকবাল একের পর এক অপকর্ম চালিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এমনকি মামলা হওয়ার পরেও তাকে গ্রেপ্তারে কোন তৎপরতা দেখা যায়নি।
চারজন ইউপি চেয়ারম্যান এই প্রতিবেদককে সার্কেল এসপি অমিত কুমার বর্মনের সঙ্গে সোর্স ইকবালের 'বিশেষ সম্পর্কে'র কথা নিশ্চিত করেছেন।
হরিণাকুন্ডু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম সোর্স ইকবালের বিষয়ে বলেন, সে আমার এলাকার সন্তান। কিন্তু সে ( ইকবাল) থানা-পুলিশ আর সার্কেল এসপির ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এলাকার মানুষ ইকবালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। অনেকেই তার খপ্পরে পড়ে সহায়-সম্বল বিক্রি করে পথে বসেছে। সে আমার দলের লোকজনেরও নানাভাবে হয়রানি করেছে। এর দৃষ্টান্তমূলক প্রতিকার দরকার।
সহকারী পুলিশ সুপার (শৈলকূপা সার্কেল) এর নাম ভাঙিয়ে ইকবালের বিভিন্ন অপকর্মের বিষয়ে সার্কেল এসপি অমিত কুমার বলেন, আমরা জেনেছি সোর্স পরিচয়ে সে বহুদিন ধরেই বহু কপকর্ম করে আসছে। প্রশাসনের পরিচয়ে কোন অপকর্ম কোনভাবেই মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। আর আমাকে জড়িয়ে ইকবাল যা কিছু বলেছেন সেগুলো শতভাগ মিথ্যা। যারা ইকবালকে টাকা দেওয়ার কথা বলেছেন তাদেরকে আমি চিনি না, কখনো দেখিনি।
মন্তব্য করুন