উলিপুর (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:২৯ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

দিনমজুর জিয়াউর রহমান এখন শিক্ষা ক্যাডার

কুড়িগ্রাম উলিপুরের মেধাবী শিক্ষার্থী জিয়াউর রহমান। ছবি : কালবেলা
কুড়িগ্রাম উলিপুরের মেধাবী শিক্ষার্থী জিয়াউর রহমান। ছবি : কালবেলা

অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর কঠোর পরিশ্রম করে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন কুড়িগ্রাম উলিপুরের মেধাবী শিক্ষার্থী জিয়াউর রহমান। ফরম পূরণের টাকা ছিল না। দিনমজুরের কাজ করতে হতো টাকার জন্য। অভাব ছিল তার নিত্যসঙ্গী। অভাবের কারণে জরাজীর্ণ ঘরে এক পাশে গবাদি পশু (গরু-ছাগল) অপর পাশে রাত কাটাতে হতো তাকে। সেই জিয়াউর এখন বিসিএস ক্যাডার।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের বাকারায় মধুপুর দালালীপাড়া গ্রামের ছকিয়ত আলী ও জোলেখা বেগম দম্পতির ছেলে তিনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, জিয়াউরের বাবা ছকিয়ত আলী ধনুষ্টঙ্কার রোগে আক্রান্ত। বর্তমানে তিনি কর্মহীন । ৩ শতক জমিতে বসতভিটা। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। শত প্রতিকুলতার মধ্যে ২০১২ সালে উপজেলার নতুন অনন্তপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান জিয়াউর রহমান। আলিমে ভর্তি হয়ে অর্থ কষ্টে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তার। পরে বই কেনার টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় যান। সেখানে একটি দোকানে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু বই কেনা হয়ে ওঠে না তার। ছোট বোনের বিয়ের জন্য সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এরপর অর্থের জন্য মুন্সীগঞ্জের আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কিছুদিন কাজ করে পুনরায় বাড়িতে এসে পড়াশোনা শুরু করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। প্রতিকুলতার মধ্যে ধরনীবাড়ী লতিফ রাজিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৪.৬৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

সরেজমিন বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) জিয়াউর রহমানের বাড়িতে গেলে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি বলেন, স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির কোচিং করার অর্থ ছিল না। তাই ঢাকায় গিয়ে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি শুরু করি। সেখানে কাজের চাপে পড়াশোনার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ২০১৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ওই বছরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মিরপুর বাঙলা কলেজে সুযোগ পেলেও অর্থের অভাবে ভর্তি হওয়া হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার, সেভাবে প্রস্তুতিও নেই। কিন্তু ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। পরে ২০১৫ সালে ভর্তি হই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। কিন্তু কীভাবে পড়াশোনার খরচ জুটবে সেই নিশ্চয়তা ছিল না। থাকা, খাওয়া ও সামান্য কিছু হাতখরচের টাকার জন্য খণ্ডকালীন কাজ করি। এ ছাড়া টিউশনি, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করে ২০১৯ সালে অনার্সে সিজিপিএ ৩.৪১ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। পরে করোনা মহামারি শুরু হলে আবার আর্থিক সংকটে পড়ি। এরমধ্যেই ২০২০ সালে মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৪৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। শেষে অনেকের সহযোগিতায় ও টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নেই। অবশেষে কপালে জুটে যায় শিক্ষা ক্যাডার। বিসিএসের রেজাল্ট যেদিন প্রকাশ হয় সেদিন শিক্ষা ক্যাডারে নিজের রোলটি দেখে চোখে পানি চলে এসেছিল। তবে ইচ্ছা ছিল প্রশাসনে চাকরি করার। কিন্তু যা হয়েছে তাই নিয়ে অনেক খুশি এখন।

জিয়াউর রহমানের মা জোলেখা বেগম বলেন, ছেলে সংসার চালিয়ে খুব দুঃখ কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। আমরা তাকে কিছুই দিতে পারি নাই। আজ ছেলের ভালো খবরে আমরা সবাই খুশি।

তিনি বলেন, ছেলে যখন ফোন করে জানালো ‘মা আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি, তখন বুঝতে পারিনি বিসিএস ক্যাডার কী জিনিস’। পরে বুঝিয়ে বলার পর আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন। সে যেন একজন ভালো মানুষ হতে পারে।

জিয়াউর রহমানের শিক্ষাগুরু অনন্তপুর দাখিল মাদ্রাসার সাবেক সুপারি মাওলানা আকবর আলি বলেন, জিয়া ছোট থেকেই খুব মেধাবী ছিল। এ কারণে তার শিক্ষা উপকরণ, মাদ্রাসায় রেজিস্ট্রেশন ও ফরম পূরণসহ যাবতীয় ব্যয় বহন করার জন্য আমরা সবাই মিলে সহযোগিতা করতাম। সে শিক্ষা ক্যাডারে সুযোগ পাওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত।

এলাকাবাসী আবুল কাশেম (৮০), সহিদুল ইসলাম (৪৮), ফারুক মিয়া (৩৫)সহ অনেকে বলেন, ছোট থেকেই জিয়া খুবই কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। সে কৃষি কাজের পাশাপাশি প্রাইভেট পড়িয়ে সংসার চালিয়েছে। আজ তার সাফল্যে আমরা গ্রামবাসী খুব খুশি।

ধরনীবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এরশাদুল হক বলেন, জিয়াউর রহমান খুবই কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন। কখনো দিনমজুর, কখনো টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে পড়াশোনা করে বিসিএস পাস করেছে। তিনি আমাদের ইউনিয়নের জন্য গর্ব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ট্রাম্পের আদেশে তিন গণমাধ্যমের কার্যক্রম স্থগিত

বাংলাদেশে আসছে পাকিস্তানি ব্যান্ড জুনুন

আবরার হত্যা মামলায় ২০ জনেরই মৃত্যুদণ্ড বহাল

যৌতুকের জন্য নববধূকে পিটিয়ে হত্যা, শ্বশুর গ্রেপ্তার

আবরার হত্যা মামলা, হাইকোর্টের রায় পড়া চলছে

আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসার পরামর্শ জাতিসংঘ মহাসচিবের

টিসিবির পণ্য ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির দুপক্ষের সংঘর্ষ, আহত ১০

পাকিস্তানে সেনা অভিযানে নিহত ১১

পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করলেন সেই ওসি

চাঁদা না দেওয়ায় ব্যবসায়ীর বাড়িতে আগুন!

১০

মালয়েশিয়ায় ৪ বাংলাদেশি এজেন্ট আটক 

১১

সাতক্ষীরায় সাবেক এমপি হাবিবের মধ্যস্থতায় ডাক্তার ও সাংবাদিকদের সংকট নিরসন

১২

বাবাকে হত্যা করে পুকুরে ফেলে দেয় ছেলে

১৩

ঢাকা ছেড়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব

১৪

আছিয়ার পরিবারের দায়িত্ব নিল জামায়াত

১৫

মাইকে ঘোষণা দিয়ে মাদক ব্যবসা ছাড়লেন মনির

১৬

কুয়াকাটা সৈকতে ভেসে এলো অর্ধগলিত ডলফিন

১৭

গাজায় ড্রোন হামলা, ৯ ফিলিস্তিনি নিহত

১৮

ট্রাকচাপায় প্রাণ গেল বাবা-ছেলের

১৯

২৬ মার্চের ট্রেনের টিকিট বিক্রি শুরু

২০
X