পাবনা প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:১০ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

চলন্ত ট্রেনে ‘অপারেশন থিয়েটার’, অন্তঃসত্ত্বার সন্তান প্রসব

ঢাকা-চিলাহাটীগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেন। ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা-চিলাহাটীগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেন। ছবি : সংগৃহীত

ঝক ঝক শব্দে চলছে আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেন। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। ঘড়ির কাটায় সময় সকাল আটটা। ট্রেনটি তখন গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। বরাবরের মতোই টিকিট চেকিং শুরু করেছেন পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী।

হঠাৎ শাহিন আলম নামের এক যাত্রী জানালেন ঘ নম্বর কোচে এক গর্ভবতী নারী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে মাইকে ঘোষণা করা হলো ‘ট্রেনের মধ্যে যদি কোনো ডাক্তার থাকেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ঘ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

এদিকে মাইকিং করার পর জ কোচ থেকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন এক চিকিৎসক। এরপর চ কোচ থেকে পঞ্চম বর্ষের একজন শিক্ষানবিশ নারী ডাক্তারও আসলেন। মাইকিং শুনে ছুটে গেলেন আরও দুজন নার্স।

এদিকে অন্তঃসত্ত্বা নারী যাত্রীর রক্তপাত যেন থামছেই না, গর্ভে থাকা চার মাসের নবজাতক গর্ভেই মারা গেল। নারী ডাক্তার, নার্সরা ওই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। ঘ কোচের নারী যাত্রীরা নিজেদের কাছে থাকা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন পুরো জায়গাটা। তিন আসনের চেয়ারের সারিটা যেন সেই মুহূর্তে হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার।

মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন চিকিৎসক ও নার্সসহ একদল মানুষ। ট্রেনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়া এক গর্ভবতী নারীর পাশে দাঁড়ালেন হাতে হাত রেখে। আর তাতে ট্রেনের মধ্যেই সেই নারী অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন এবং ট্রেনের মধ্যে রক্তপাত হয়ে তার গর্ভে থাকা চার মাসের নবজাতক মারা যায়। এমন পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ান ট্রেনের যাত্রীরা।

রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এমন ঘটনার সাক্ষী হলেন ঢাকা-চিলাহাটীগামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনের পুরো যাত্রীরা। ট্রেনের মধ্যেই ওই নারীর মৃত বাচ্চা প্রসব করান ট্রেনে থাকা চিকিৎসক ও নার্সরা। ট্রেনের কামরা হয়ে যায় অপারেশন থিয়েটার। এ যেন সিনেমার কাহিনীর বাস্তব চিত্র।

ওই ট্রেনে দায়িত্বরত পার্বতীপুর হেডকোয়ার্টারের টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ট্রেনটি ঢাকা থেকে চিলাহাটী যাচ্ছিল। বরাবরের মতোই ট্রেনের পিছনের কোচ থেকে টিকিট চেকিং শুরু করি। সঙ্গে ছিলেন আরেক টিটিই বেলাল হোসেন। রাত আটটা নাগাদ ট্রেনটি তখন গাজীপুরের মহেড়া স্টেশন পার হচ্ছিল। টিকিট চেক করতে ট্রেনের জ নম্বর কোচে যাবার পর হঠাৎ করে শাহিন আলম নামের এক যাত্রী জানান ঘ নম্বর কোচে একজন গর্ভবতী মহিলা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

সঙ্গে সঙ্গে আমার পেছনে থাকা গার্ড সিফাত হোসেনকে জানাই দ্রুত পিএ অপারেটরকে ট্রেনের মাইকে একটা ঘোষণা করতে বলেন যে ‘ট্রেনের মধ্যে যদি কোন ডাক্তার থাকেন তাহলে জরুরি ভিত্তিতে ঘ কোচে তাকে বিশেষ প্রয়োজন, একজন গর্ভবতী মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

মাইকিং করার পর একজন ডাক্তার (ঢাকার ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সানাউল্লাহ) জ কোচ থেকে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এরপর চ কোচ থেকে পঞ্চম বর্ষের একজন শিক্ষানবিশ নারী ডাক্তারও (রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ডা. আফসানা ইসলাম রোজা) আসলেন। মাইকিং শুনে দুজন নার্সও দ্রুত ঘ কোচে ছুটে গেলেন।

এরপর চিকিৎসক গর্ভবতী ওই নারীর রক্তপাত দেখে জরুরীভাবে হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। এর মধ্যে ৯৯৯-এ কল দিলেন এক যাত্রী। সিদ্ধান্ত হলো, টাঙ্গাইল স্টেশনে ট্রেন থামানো হবে। ভাগ্য সহায় হলো চিলাহাটি এক্সপ্রেসের ক্রসিং পড়েছে সেখানে। ৯৯৯ থেকে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর দেওয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্সের চালকের সঙ্গে কথা হলো, তারাও প্রস্তুত।

এদিকে ওই নারীর স্বামী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। একজন যাত্রী জানান তার পকেটে মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকার মতো আছে। তাৎক্ষণিক সব যাত্রীরা যে যার মতো টাকা সংগ্রহ করা শুরু করলেন। প্রায় ৫ হাজারের মতো টাকা রোগীর স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হলো।

টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, আল্লাহর রহমতে ওই নারীর মৃত বাচ্চাটিকে ডাক্তার-নার্স সহ সবার সহযোগিতায় বের করা হয়। ডা. সানাউল্লাহ সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, রোগী এখন অনেকটা আশংকামুক্ত। কিন্তু রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। ট্রেনের নারী যাত্রীরা ব্যাগ থেকে কাপড় ও অন্যান্য যাবতীয় জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করলেন। রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সেই স্যালাইন, হেক্সিসল, ডেটল যাত্রীরা যার কাছে যা ছিল তা দিয়ে সাহায্য করলেন। পরে অবশ্য তাকে আর হাসপাতালে নিতে হয়নি।

সব কিছু যখন অনেকটা স্থিতিশীল, তখন দুশ্চিন্তা শুরু হলো জরুরি ভিত্তিতে কিছু ওষুধের। ডাক্তার সাহেব ওষুধ লিখে দিলেন। তখন ঈশ্বরদীর টিটিই আব্দুল আলীম বিশ্বাস মিঠুকে ফোন করে বিস্তারিত জানানো হলো। ঈশ্বরদীতে তখন মুষলধারে বৃষ্টিপাত চলছে। তবুও তিনি মোবাইলে প্রেসক্রিপশন পেয়ে নিজেই ওষুধের দোকানে গিয়ে সব ওষুধ কিনে রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে পাঠালেন। পরে ট্রেন স্টেশনে থামলে ওষুধ নিয়ে চিকিৎসকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। তিনি রোগীর স্বামীকে ওষুধ খাওয়ানোর নিয়ম বুঝিয়ে দেন।

পরে রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ ওই নারী ও তার স্বামী দিনাজপুরের ফুলবাড়ি স্টেশনে নামেন। আর চিকিৎসক সানাউল্লাহ সারাটা রাত, সারাটা পথ ওই রোগীর পাশে বসেছিলেন। চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক আফসানা ইসলাম রোজা, নার্স ফারজানা আক্তার, মুন্নি খাতুন, নার্সিং ইন্সট্রাক্টর রেবেকা সুলতানা, খাদিজা খাতুন নিশা, রুমি ইসলাম। এভাবেই একদল মানবিক মানুষের সহযোগিতায় বেঁচে যান একজন নারী।

এ বিষয়ে টিটিই আমিরুল হক জাহেদী বলেন, ‘আমার চাকরি জীবনে ট্রেনের মধ্যে বেশকিছু মানবিক ঘটনা দেখেছি। তবে এই ঘটনাটি অভূতপূর্ব। ট্রেনের মাইকে ঘোষণা শুনে ডাক্তার, নার্সসহ অন্যরা যেভাবে একজন অসুস্থ নারীর পাশে সহযোগিতা বাড়িয়ে দিলেন তা অনন্য। স্যালুট জানাই ওই সব মানবিক মানুষদের।’

ডা. সানাউল্লাহ বলেন, ‘আমার বাড়ি দিনাজপুরে। গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। ট্রেনের মধ্যে মাইকে ঘোষণা শুনে একজন চিকিৎসক হিসেবে বসে থাকতে পারিনি। যদিও ট্রেনের মধ্যে কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঢাল-তলোয়ার কিছুই ছিল না, যে কারণে চ্যালেঞ্জ ছিল। তার মধ্যেই সবার সহযোগিতায় নারীর প্রসব করানো সম্ভব হয় এবং তিনি বেঁচে যান। বড় কোনো বিপদ হয়নি। আমরা প্রথমে টাঙ্গাইল স্টেশনে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানো পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম তিনি স্বাভাবিক আছেন। এ যেন সিনেমার কাহিনীর মতো। আমার জীবনে একটি অনন্য ঘটনার সাক্ষী হলাম।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১০

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১১

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১২

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৩

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৪

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

১৫

কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি

১৬

পাকিস্তানের জলসীমায় বিপুল তেল-গ্যাস মজুতের সন্ধান

১৭

বিসিবির দুর্নীতির তদন্ত দাবি সাবেকদের

১৮

পাবিপ্রবি ছাত্রলীগ কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ

১৯

জেল খেটেছি তবু শেখ হাসিনার মতো পালিয়ে যাইনি : সাবেক এমপি হাবিব

২০
X