নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনায় ১১ বছর পূর্ণ হয়েছে রোববার (২৭ এপ্রিল)। দীর্ঘ ১১ বছরেও নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুন মামলার রায় কার্যকর হয়নি। এ মামলায় নিম্ন আদালতে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ডসহ ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। পরে উচ্চ আদালত ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্যান্য আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।
তবে দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয় বছর ধরে সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আটকে আছে। অভিযোগ উঠেছে, বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার রায় কার্যকর করতে বিলম্ব করেছে। এ নিয়ে স্বজনদের মনে ক্ষোভ ও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহরণ হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, মনিরুজ্জামান স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার এবং তার ব্যক্তিগত গাড়িচালক ইব্রাহিমসহ সাতজন। তিন দিন পর বন্দর উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের মেয়ের জামাই বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় আলাদা দুটি মামলা করেন।
সেই মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১ এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এম মাসুদ রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদানের আদেশ দেন।
পরে উচ্চ আদালতে আপিল করা হয়। ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্যান্য আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন উচ্চ আদালত। বর্তমানে মামলাটি সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে সাড়ে ছয় বছর ধরে শুনানির অপেক্ষায় আটকে রয়েছে।
এ দিকে বিচারের আশায় এখনও অপেক্ষার প্রহর গুণছেন নিহতের স্বজনরা। তবে এখনো ভয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে নিহতের স্বজনদের। নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী ও মামলার বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, মামলায় বাদ পড়ে যাওয়া আসামিরা সব সময় আমাদের হুমকি ধামকি দিয়ে আসছে। ফলে আমরা সব সময় আতঙ্কে থাকি। আমরা এখনো ভয় পাই। তাদের লোকজন এখনো সক্রিয় রয়েছে।
নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের ছোট ভাই আব্দুস সালাম বলেন, শামীম ওসমানের পালিত লোক নূর হোসেন। সে সব সময় শামীম ওসমানের হুকুম তামিল করতো। জিয়াউল হাসান কিছুদিন আগেও বলেছে, শামীম ওসমান এ সাত খুনের ব্যাপারে সব জানে। তাদের হাত অনেক লম্বা। আসামিদের হাত অনেক ওপর মহলে থাকার ফলে মামলায় রায় কার্যকর হতে বিলম্ব হচ্ছে।
নিহত তাজুল ইসলামের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম রাজু বলেন, আসামিরা আওয়ামী লীগের সরকারি কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় মামলার রায় কার্যকর করতে এতো টালবাহানা করেছে। এ কারণে দীর্ঘ ১১ বছরেও মামলার রায় কার্যকর হয়নি।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ফলে শেখ হাসিনা সরকার এ রায়কে বিলম্বিত করার চেষ্টা করেছে। অ্যাপিলেট ডিভিশনে যাতে শুনানি না হয় তা নিশ্চিত করেছে। তবে বর্তমান সরকার এ মামলার রায় দ্রুত কার্যকর করলে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, এ মামলার প্রধান আসামি কর্নেল তারেক সাঈদ সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই। অন্য আসামিরাও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের আত্মীয় স্বজন। ওই সময় যদি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করা হতো তাহলে সাবেক এমপি শামীম ওসমান ও র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউলের নাম উঠে আসতো। তারাও এ ঘটনায় জড়িত ছিল। তাদেরকে সরকার রক্ষা করেছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) আবুল কালাম আজাদ জাকির বলেন, এ মামলা নিয়ে বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। মামলাটি যেন শিগগিরই নিষ্পত্তি হয় সেজন্য তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।
মন্তব্য করুন