কুড়িগ্রামের রাজারহাটে প্রতি বছর সুপারি মৌসুমে কোটি কোটি টাকার সুপারি উৎপাদন হয়ে থাকে। জেলার অন্যতম বৃহৎ সুপারির হাটে বিক্রি হয় কোটি টাকার সুপারি। সরবরাহ হয়ে থাকে দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে। সপ্তাহে দুদিন শনি ও বুধবার বসে এই হাট।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) সকালে সরেজমিনে রাজারহাট বাজার ঘুরে দেখা যায়, হলুদের সমারোহ। বাজারে বিক্রেতা ও ক্রেতার সমাগমও চোখে পড়ার মতো। ভোরের শুরুতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে মোটরসাইকেল, ভ্যান, নছিমন, বাইসাইকেলে করে বস্তা বা ঝাঁকা ভর্তি সুপারি নিয়ে হাটে আসছেন ব্যবসায়ীরা। চলছে দাম কষাকষি। বিক্রিও হচ্ছে খুব। পাইকাররা সুপারি ক্রয় করে নিজেদের গদিতে (ভাড়া করা ঘর) স্তূপ করে রাখছেন। এই সুপারি আবার বাছাই এবং চূড়ান্ত গণনা শেষে বস্তাভর্তি করতে কাজ করছেন শতাধিক শ্রমিক।
রাজারহাটের চাহিদা মিটিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সুপারি লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, খুলনা, ঢাকাসহ দেশের ২০টি জেলায় সরবরাহ করা হয়। এছাড়াও উপজেলার সিঙ্গেরডাবরী, নাজিমখাঁ বাজারেও সুপারি বিক্রি হয়। চাহিদা থাকায় ভালো দামও পাচ্ছেন বিক্রেতারা। এভাবে বাজারদর অব্যাহত থাকলে সুপারি চাষিরা লাভবান হবে বলে জানান বিক্রেতারা। কুড়িগ্রাম জেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল সুপারি। সুপারি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাতও এই জেলা।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে কুড়িগ্রামে ৩৭০০ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষ হয়। এতে সুপারি উৎপাদন হয়েছিল ২৫ হাজার ৬০৫ টন। ২০২৪ সালে ৪০৯৭ হেক্টর জমিতে সুপারি চাষের লক্ষ্যমাত্রা। উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল ২৫ হাজার ৬০৫ টন। তবে এবার চাষাবাদ হয়েছে ৪ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে। এতে উৎপাদন হয়েছে ২৫ হাজার ৬৬৩ টন সুপারি। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে সব থেকে বেশি সুপারি উৎপাদিত হয় রাজারহাট উপজেলায়। এই উপজেলায় এ বছর ১ হাজার ২১০ হেক্টর জমিতে ৪ হাজার ১১৪ টন সুপারি উৎপাদন হয়েছে।
আবুল কালাম আজাদ নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, সুপারি হাটের জন্য বিখ্যাত রাজারহাট বাজার। রাজারহাট বাজার জামে মসজিদের সামনে অবস্থিত এই হাটে কোটি কোটি টাকার সুপারি বেচাকেনা হয়। খাজনা কম হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সুপারির বস্তাপ্রতি ১৫-২০ টাকার ইজারা নেওয়া হয়। খাজনা যদি একটু বেশি হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা লাভবান হবে না।
রাজারহাট উপজেলার ফরকেরহাট থেকে সুপারি বিক্রি করতে আসা মিরাজুল ইসলাম বলেন, এ বছর আমাদের সুপারির ফলন ভালো হয়েছে। সুপারির আকারও অনেক ভালো। পাশাপাশি দামও ভালো পাচ্ছি। সুপারির এমন বাম্পার ফলনে আমরা খুব খুশি।
সুপারি গণনা ও বাছাই কাজে নিয়োজিত শ্রমিক শহিদ, ইউনুস ও মোবারেক জানান, সপ্তাহে দুই দিন আমরা এই হাটে সুপারি গণনা করি। ফজরের নামাজের পরেই হাটে চলে আসি। রাত ১০টার সময় বাড়িতে যাই। এক কুড়ি সুপারি বাছাই শেষে গণনা করে বস্তায় ঢুকালে আমরা পাই ৫ টাকা। প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা আয় হয় আমাদের। সুপারির মৌসুমে এই কাজ করেই আমাদের সংসার চলে।
রাজারহাট বাজারের আড়তদার দুলাল বলেন, এই হাটে আমরা ২০-৩০ জন আড়তদার আছি। প্রতি হাটে দেড় থেকে ২ হাজার বস্তা সুপারি আসে এই বাজারে। এখন বাজার মূল্য ভালো। গত বছরের তুলনায় এবার আবহাওয়া ভালো থাকায় সুপারির উৎপাদনও ভালো হয়েছে। এভাবে থাকলে আমরাও লাভবান হব এবং চাষিরাও লাভবান হবেন।
সুপারি ব্যাপারী এনদাদুল হক বলেন, রাজারহাট থেকে সুপারি কিনে আমরা সরাসরি রংপুরের আশপাশের জেলাতেও বিক্রি করি। এ বছর সুপারির বাজার ভালো। এক কুড়ি সুপারি কখনো ২৩০ থেকে ৪০০ টাকায় আবার কখনো ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। আশাকরি মৌসুমের শেষ পর্যন্ত বাজার দর অব্যাহত থাকলে ব্যবসা ভালো হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কুড়িগ্রামের প্রশিক্ষণ অফিসার ড. মো. মামুনুর রহমান বলেন, সুপারির জন্য কুড়িগ্রাম জেলা প্রসিদ্ধ। এছাড়া বর্তমানে বাজারে ভালো দাম পাওয়ায় সুপারি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। আমরাও কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি যাতে তারা লাভবান হতে পারেন।
রাজারহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাইফুন্নাহার বলেন, উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় এই সুপারি রপ্তানি হয়। রাজারহাটে প্রায় সব পরিবারে সুপারির গাছ রয়েছে। সুপারি শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে চাষিদের সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
মন্তব্য করুন