দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার দেবীপুর গ্রামের পাশের বন বিভাগের ঘন জঙ্গলে বৈশাখের বৃহস্পতিবার যেন প্রাণ ফিরে পায়। বছরের একটি সময়, প্রতি বৈশাখ মাসে প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে বসে একটি ব্যতিক্রমী ও শতবর্ষী মেলা— যা স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘চুনের মেলা’ নামে। ইতিহাস আর লোকবিশ্বাসে মোড়ানো এই মেলা যেন এক অনন্য সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।
বিকেল গড়াতেই দেখা যায় আশপাশের গ্রাম ও দূরদূরান্তের এলাকা থেকে নারী-পুরুষ, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠর ঢল নেমেছে সেই জঙ্গলের পথে। কারও হাতে খাজা-বাতাসার প্যাকেট, কেউ বা চুনের থলে পলিথিনে বেঁধে নিয়ে এসেছেন। জঙ্গলের মাঝখানে এক বিশাল পাকুড় গাছের ছায়ায়, উঁচু ঢিবির ওপর স্থির হয়ে রয়েছে এক কিশোর— দুই হাতে সমাধির গায়ে চুন লেপে চলেছে এক নাগাড়ে। এ দৃশ্যকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে এক গভীর আধ্যাত্মিক আবহ।
এই ঢিবিটি আসলে অনাহারী দেওয়ান নামক এক অলৌকিক ব্যক্তির সমাধি, যিনি এলাকাবাসীর বিশ্বাস অনুযায়ী জীবন্ত অবস্থায় একটি পানিভর্তি মাটির পাত্রসহ একটি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে আর ফিরে আসেননি। চরকাই গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুল ফকির জানান, তার দাদা সিরাজ উদ্দিন ফকির সেই ইতিহাসের সাক্ষী। সেই থেকেই এই সমাধিকে ঘিরে মানুষের আগ্রহ ও ভক্তি বেড়েছে বহু গুণ।
মাজারের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষজন থলে ভর্তি চুন এক কিশোর লুৎফর রহমানের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সে চুন নিয়ে সমাধির গায়ে লেপন করছে। কেউ কেউ চোখ বন্ধ করে প্রার্থনায় নিমগ্ন হচ্ছেন, কেউবা হাতের ইশারায় প্রণাম করছেন। মনের আশা পূরণের এই নির্ভরতায় মিশে আছে বিশ্বাস আর ভালোবাসা।
মেলার পাশে দেখা গেল চুনের দোকান সাজিয়ে বসেছেন তিন বৃদ্ধ বিক্রেতা— নিত্যানন্দ সরকার (৬৮), জগদীশ সরকার (৬৩) ও সুনীল সরকার (৭৫)। তাদের দোকানে উপচে পড়ছে ভিড়। নিত্যানন্দ সরকার বলেন, ‘মুই ৪০ বছর ধরে এই ম্যালাতে চুনের দোকান দ্যাও। আগে বাপ-দাদা দ্যাছোলো। আজও এক মণ চুন বিক্রি হইচে।’ ২০ ও ৪০ টাকার বিনিময়ে লোকজন পলিথিনে ভরা চুন কিনছেন, কেউ নিজের জন্য, কেউ পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের মানতের চুন দিতে এসেছেন।
দর্শনার্থীদের জন্য রয়েছে আরেক আয়োজন— মেলার মাঠজুড়ে খেলনা, খাবার, প্রসাধনীসহ শতাধিক দোকান। বাতাসা, ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, জিলাপি আর খাজার গন্ধে ভরে গেছে বাতাস। শিশুদের খুশিতে মুখর চারপাশ। বড়রাও ব্যস্ত প্রার্থনা আর কেনাকাটায়।
সমাধির পাশে বসে আছেন মেহেরজান নামের এক বৃদ্ধ নারী, যিনি নিজেকে অনাহারী দেওয়ানের দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে পরিচয় দেন। ভক্তরা তার হাতে তুলে দিচ্ছেন খাজা বা বাতাসা, যা তিনি বিলিয়ে দিচ্ছেন আগতদের মাঝে। মেলাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক ধরনের ধর্মীয় ও সামাজিক মিলনমেলা, যেখানে ভক্তি আর উৎসব পাশাপাশি চলে।
মেলার অন্যতম আয়োজক শহিদুল ইসলাম চৌকিদার ও সাকিল (৩০) জানান, আগে মাজারের একেবারে পাশে মেলা বসত। এখন ভিড় ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে কিছুটা দূরে ফাঁকা মাঠে বসানো হচ্ছে মেলা। এ মেলা বৈশাখ মাসের আরও দুই বৃহস্পতিবার বসবে। আমাদের শোনা মতে, এ মেলা ৩০০ বছরের পুরোনো।
রূপনগর মহল্লার বাসিন্দা শাহিনুর রহমান (৪৬) বলেন, ‘আমি আট বছর ধরে নিয়ম করে মাজারে চুন দিচ্ছি। আল্লাহর রহমতে আমার অনেক মানত পূরণও হয়েছে। এবার নিজের জন্য চুন দিতে এসেছি।’
চুনের মেলা সম্পর্কে বিরামপুর পাইলট স্কুলের সহকারী শিক্ষক ইকবাল আহম্মেদ বলেন, ‘আমার শৈশব থেকেই দেখছি, বৈশাখ মাসের প্রতিটি বৃহস্পতিবার মানুষ গাছের গোড়ায় ও মাজারে চুন দিচ্ছে। এটি শুধু ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক নয়, একটি জীবন্ত ঐতিহ্য।’
তবে স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত নয়। বিরামপুর থানার পুলিশ পরিদর্শক মমতাজুল হক জানান, চুনের মেলার বিষয়ে আয়োজকদের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। তবে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দরকার হলে পুলিশ সহায়তা দেবে।
মন্তব্য করুন