মিনহাজ তুহিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৫২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী প্রধান ৪ সমস্যা

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যদ্বয়। সৌজন্য ছবি
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণা প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যদ্বয়। সৌজন্য ছবি

চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী এমন ৪টি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক। পাশাপাশি এসব সমস্যা সমাধানে তারা অভিজ্ঞদের সঙ্গে ফোকাস গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সমাধানও তুলে ধরেছেন।

বুধবার (১৬ এপ্রিল) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহ্ইয়া আখতারের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার হাতে প্রতিবেদনটি তুলে দেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ জন শিক্ষক দুই মাস ধরে গবেষণাটি করেছেন। গবেষণায় ৪টি প্রধান সমস্যার ভেতরে অনেকগুলো কারণ তুলে ধরা হয়েছে। গবেষকরা আশা করছেন, তাদের প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা সমস্যা অনেকাংশেই নিরসন করা সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনার আলোকে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি ‘গবেষণা টিম’ গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গবেষণা টিম দুই মাস ধরে ফোকাস গ্রুপ আলোচনা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ইউএনডিপির রিপোর্ট, সংবাদপত্রের নিবন্ধ, দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন ও বিভিন্ন গবেষণাপত্রের আলোকে ২৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন তৈরি করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিনের নেতৃত্ব গবেষণা টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমিন, অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া, অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন, অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক ড. মো. আলাউদ্দিন মজুমদার, অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল সরোয়ার, অধ্যাপক ড. এন এম সাজ্জাদুল হক ও অধ্যাপক ড. আমির মুহাম্মদ নসরুল্লাহ (সদস্য সচিব)।

প্রধান চার সমস্যা হলো- গবেষণায় উঠে আসা প্রধান ৪টি সমস্যা হলো- পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূতত্ত্ববিষয়ক প্রভাব; জলাবদ্ধতায় কারিগরি ও প্রকৌশলবিষয়ক প্রভাব; জলাবদ্ধতায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রভাব এবং জলাবদ্ধতায় শাসন ও জনসচেতনতাবিষয়ক প্রভাব।

গবেষণা প্রতিবেদনে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ হিসেবে অতিবৃষ্টি/বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন, নদী দখল এবং ভরাট, নগরায়ণ ও ভূমির ব্যবহার পরিবর্তন, নিম্নাঞ্চলীয় টপোগ্রাফির প্রভাব, ভূতাত্ত্বিক দুর্বলতা ও প্রভাব, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করেছেন।

জলাবদ্ধতায় কারিগরি ও প্রকৌশলবিষয়ক প্রভাব বিষয়ে অবাধে পাহাড় ও গাছ কাটা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা ও অপরিকল্পিত স্লুইস গেইট ও নদীর নাব্যতা সংকটকে দায়ী করেছেন।

জলাবদ্ধতায় শাসন ও জনসচেতনতাবিষয়ক সমস্যার পেছনে সরকারি সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয়হীনতা, বিল্ডিং স্থাপনা আইন ও বিল্ডিং কোডের প্রয়োগের অপর্যাপ্ততা,অবকাঠামো নির্মাণে ব্যক্তিগত অনীহা; বৃষ্টিপাত, বন্যা, ড্রেনেজ ক্যাপাসিটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ডাটার দুষ্প্রাপ্যতা ও মনিটরিংয়ের অভাব, সামাজিক বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার প্রভাব মোকাবিলায় প্রশাসনের অক্ষমতা, নদী দখল ও অকার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন।

সুপারিশমালা- প্রতিবেদনে জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বৃষ্টিপাত ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা; প্রাকৃতিক জলাশয়, খাল, নদী সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা; নিন্মাঞ্চলীয় এলাকার পানি নিষ্কাশনে বিশেষ পরিকল্পনা করা; ভূতাত্ত্বিক দুর্বলতা মোকাবিলায় পাহাড় দখলমুক্ত করা এবং পাহাড়ধসে যেন নালা বন্ধ না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা; শহরের বাস্তুতন্ত্র রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য বেশি গাছ লাগানো; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবিলা; ডাটাবেজ প্রণয়ন, জলাবদ্ধতার হটস্পট নির্ধারণ ও ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা; স্লুইসগেট ও পাম্পগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা; নগরীর বর্জ্য উৎপাদনের হটস্পট সমূহ খুঁজে বের করা।

নগরীর নালা-নর্দমা এবং খাল আবর্জনা মুক্ত করার জন্য ভাসমান বর্জ্য সংগ্রহ ফাঁদ স্থাপন করা, খাল পাড়ে ২০০ থেকে ২৫০ মিটার পর পর বর্জ্য বিন স্থাপন করা, খাল পরিষ্কার করে প্রয়োজন এখন ও দখলমুক্ত করা, নগরবাসী অংশগ্রহণের জনসচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি গ্রহণ করা।

সুপারিশমালায় সরকারি সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টির জন্য অযোগ্য ও রাজনৈতিক বিবেচনা নিয়োগ প্রাপ্তদের সরিয়ে অধিকতর যোগ্য ও সৎ লোকদের পদায়ন করতে বলা হয়। পাশাপাশি প্রকল্প মনিটরিং ব্যবস্থা কার্যকর এবং নিয়মিত করতে বলা হয়। এছাড়া প্রয়োজনে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ত করতে বলা হয়।

সামাজিক বৈষম্য রোধ করা এবং নগরে বসবাসকারী বস্তিবাসীদের মূল্যায়ন করার সুপারিশ করা হয়।

গবেষণা টিমের সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমীন কালবেলাকে বলেন, আমরা চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে দীর্ঘ দুই মাস ধরে কাজ করেছি। এক্ষেত্রে আমরা ফোকাস গ্রুপ আলোচনা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ইউএনডিপির রিপোর্ট, সংবাদপত্রের নিবন্ধ, দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন ও বিভিন্ন গবেষণাপত্রের সহযোগিতা নিয়েছি। আমাদের এই গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন কলে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

গবেষণা টিমের প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, আমরাও কাজ করেছি। আমরা প্রতিবেদনে স্বল্প মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ তুলে ধরেছি। আমাদের বিশ্বাস এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে করলে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা কমবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেসব গবেষণা করছে, সেখানেও ভালো দিক থাকবে। সেগুলোও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আমরা অনেক গবেষণা দেখি, যেগুলো কাগজে-কলমেই থেকে যায়। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেন গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশগুলি বাস্তবায়ন করে।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (অ্যাকাডেমিক) অধ্যাপক ড. শামীম উদ্দীন খান কালবেলাকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ অভিপ্রায় ও নির্দেশনায় চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ সদস্যের ‘গবেষণা টিম’ চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে করণীয় বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি সুপারিশমালা রয়েছে। আমরা এই প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দিয়েছি। তিনি গবেষণা টিমকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখবেন বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সার্বিক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চক্রান্ত!

১৪ ঘণ্টা পর ভেসে উঠল সেই শিশুর মরদেহ

কুমিল্লায় বিএনপি-এনসিপির পাল্টাপাল্টি সমাবেশ, জনমনে আতঙ্ক

আরএসএস প্রচারকরা বিয়ে না করে থাকেন কেন?

নিখোঁজ স্কুলছাত্রের মরদেহ মিলল রেললাইনের পাশে

ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বজ্রবৃষ্টির শঙ্কা

১৩ ঘণ্টায়ও উদ্ধার হয়নি নালায় পড়ে নিখোঁজ শিশুটি

অপবাদ সইতে না পেরে শরীরে আগুন, ৫ দিন পর যুবকের মৃত্যু

বাণিজ্যযুদ্ধ / চীন নাকি ট্রাম্প, কে কাকে বেশি চাপে রাখছে

দুপুরের মধ্যে ১০ জেলায় ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

১০

চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ও ছাত্রদলের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ

১১

পাকিস্তানজুড়ে কেএফসিতে হামলা, গ্রেপ্তার ১৭৮

১২

‘পার্বত্য মন্ত্রণালয়গুলো প্রকৌশল বেইসড হয়ে গেছে, পরিবর্তন আনা হবে’

১৩

সীমান্তে ১২ কেজি রুপার গয়না ফেলে ভারতে পালাল পাচারকারী

১৪

ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে এনসিপির বৈঠক আজ

১৫

ট্রাম্প কি এবার ইউক্রেনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন?

১৬

১৯ এপ্রিল : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৭

আরও ৬৪ মৃত্যু / গাজায় এখনই খাদ্য প্রয়োজন: ডব্লিউএফপি

১৮

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯

১৯ এপ্রিল : টিভিতে আজকের খেলা

২০
X