বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা নগরীর বৈশাখী মাছের মেলা ঐতিহ্য ও বিশেষত্বের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছ। যুগ যুগ ধরে বৈশাখী মাছের মেলার ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে রাজগঞ্জের মৎস্য ব্যবসায়ীরা। পহেলা বৈশাখ ঘিরে রাজগঞ্জ মৎস্য বাজারের ভেতর ছাপিয়ে মাছের মেলা স্থান করে নেয় এক সময়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের দুই পাশে মোগলটুলির পূর্বদিকের মোরগবাজার, থানা রোড হয়ে পশ্চিমদিকে হাইস্কুল পর্যন্ত এলাকা। বৈশাখে রাজগঞ্জ বাজারের মাছের মেলায় এ অঞ্চলের লোকজন খুঁজে পায় বাঙালি ঐতিহ্যের ছোঁয়া।
সরেজমিনে পহেলা বৈশাখের দিন সোমবার (১৪ এপ্রিল) গিয়ে দেখা গেছে, বৈশাখের প্রথমদিন ভোরের সূর্য ওঠার আগেই মৎস্য আড়তগুলোতে হাঁকডাক শুরু হয়। কোথাও পানির মধ্যে জীবিত মাছ। কোথাও মাছের ডালার মধ্যে সাজানো আছে কাতলা মাছ। এর সঙ্গে আছে বড় আকারের রুই, মৃগেল ও কার্প মাছও। কাতলা মাছের কেজি সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, সর্বনিম্ন ৪০০ টাকা। মাছের আকার ভেদে দরদাম নির্ধারণ করা হয়। দেশি কাতলা (কুমিল্লার পুকুরের মাছ) মাছের ওজন কম; তবে দাম বেশি, স্বাদও ভালো। আবার বড় বড় হাফড্রামে পানিতে রেখে জীবিত মাছ যশোর, রাজশাহী, খুলনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, আশুগঞ্জ থেকে ট্রাকযোগে ‘বিশেষ পদ্ধতিতে’ জীবিত রেখে বাজারে আনা হয়। দেশীয় মাছ দাউদকান্দি, চান্দিনা, দেবিদ্বার, চান্দিনা, লাকসাম, ব্রাহ্মণপাড়া থেকে রাজগঞ্জসহ নগরীর অন্যান্য বাজারে স্থান পায়। নগরীতে রাজগঞ্জ, চকবাজার, নোয়াপাড়ায় প্রায় ৩৫টি মাছের আড়ত রয়েছে। আড়তের বাইরে পুকুর-দিঘী থেকে ধরা মাছও বাজারে তুলেছেন বিক্রেতারা।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, মৎস্যখাতে বিপ্লব সৃষ্টি করা কুমিল্লা জেলায় কেবল মাত্র নগরীতেই নববর্ষের প্রথমদিনে কয়েক কোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে। শতবর্ষের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কুমিল্লা নগরের রাজগঞ্জ বাজারে কাতলা মাছের মেলা বসে। মেলায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা বড় আকারের কাতলা মাছ নিয়ে হাজির হন। মাছের আকার ও ওজন অনুযায়ী দরদাম নির্ধারিত হয়। বৈশাখে অতিথি আপ্যায়ন ও স্বজনদের উপহার দেওয়া হয় কাতলা মাছ। মেলাকে কেন্দ্র করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষের ঢল নামে বাজারে। থাকে উৎসুক জনতার ভিড়ও। মেলায় হাজার হাজার কাতলা মাছ বিক্রি হচ্ছে। রাত পর্যন্ত এই মেলা চলবে।
এ বছর কুমিল্লা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ৩ শতাধিক বিক্রেতা বিভিন্ন সাইজের মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন। এ বছর ১ হাজার মণ মাছ বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। যার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা।
মেলায় ১২ কেজি ওজনের একটি জীবিত কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ৯ হাজার ৬০০ টাকায়। প্রতি কেজি মাছের দাম ৮০০ টাকা। পাঁচ কেজি ওজনের রুই মাছ বিক্রি হয়েছে ৬০০ টাকা কেজি ধরে।
মেলায় মাছ কিনতে এসেছেন কুমিল্লা নগরের বাগিচা গাঁ এলাকার বাসিন্দা জাহিদ হাসান। তিনি বলেন, প্রতি বছরই মেলাতে মাছ কিনতে আসি। অন্য বছরের তুলনায় মাছের দাম বেশি মনে হয়। তবে মাছের দাম কমবেশি বড় কথা নয়, বৈশাখের প্রথমদিন সবাই আনন্দের সঙ্গে মাছ কিনতে আসে দেখে অন্য রকম ভালো লাগে। আমি নিজের জন্য ৮ কেজি ওজনের একটা কাতল মাছ কিনেছি ৭৫০ টাকা কেজি ধরে।
নগরীর রাজগঞ্জ বাজারের মৎস্য আড়তদার রবিউল আউয়াল জানান, এবারে নববর্ষের প্রথমদিন রাজগঞ্জে যে পরিমাণ মাছ স্থান পেয়েছে তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ৮০ ভাগই কাতলা মাছ। মূলত বৈশাখে মাছের মেলায় কাতলের দিকেই ক্রেতাদের দৃষ্টি বেশি পড়ে।
রাজগঞ্জ বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান বলেন, চাঁদপুরের কচুয়ার বিভিন্ন পুকুর, কুমিল্লার দেবীদ্বার, মুরাদনগর ও ব্রাহ্মণপাড়া এলাকা থেকে মাছ ওঠানো হয় মেলায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর ও আখাউড়া, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, যশোর থেকেও ব্যবসায়ীরা মাছ এনেছেন।
কুমিল্লার সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাদেক হোসেন মামুন বলেন, মাছের জন্য বিখ্যাত কুমিল্লা নগরের রাজগঞ্জ বাজার। ঐতিহ্য ও বিশেষত্বের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জের বৈশাখী মাছের মেলাটি। কাতলা মাছের মেলার বয়স ১০০ পার হয়েছে। মেলা থেকে বড় মাছ কিনে আত্মীয়স্বজনের বাসায় পাঠানো হয়। এই সময়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মাছ দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করেন।
মন্তব্য করুন