দৈনিক কালবেলা পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, চট্টগ্রামে স্বজনপ্রীতি, নাবিকদের হয়রানি, নাবিক সিলেকশনে অনিয়ম, নানাবিধ অনিয়ম ও বৈষম্য সৃষ্টির অভিযোগের প্রেক্ষিতে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) দুদক, জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-১ থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট টিম এ অভিযান পরিচালনা করে।
অভিযানের প্রাথমিকভাবে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযান সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
দুদক অভিযান সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযোগকারীদের সাথে কথা বলে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছে। অতঃপর অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রাথমিক পর্যালোচনায় বেশ কিছু অভিযোগের সত্যতা রয়েছে মর্মে টিমের নিকট প্রতীয়মান হয়।
অভিযানকালে অভিযোগের বিষয়ে যাবতীয় রেকর্ডপত্রাদি সংগ্রহ করেছে এনফোর্সমেন্ট টিম, যা পর্যালোচনান্তে টিম কমিশন বরাবর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।
উল্লেখ্য, দৈনিক কালবেলায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি ‘বিদেশি জাহাজের নাবিক হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোনো ধরনের আইনের তোয়াক্কা না করে এবং জালিয়াতির মাধ্যমে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একটি চক্র বিদেশি সনদের বিপরীতে করা হয়েছে সিডিসি (কন্টিনিউয়াজ ডিসচার্জ সার্টিফিকেট) প্রদান। এতে নিষিদ্ধ হতে পারে বিদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিক নিয়োগ। ফলে দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে আর আশঙ্কা আরো অধিক বঞ্চিতের। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদের নেতৃত্বেই হচ্ছে এসব। আর নীতিমালা লঙ্ঘন করে সিডিসি প্রদান করায় এরইমধ্যে হাইকোর্টে দায়ের করা হয়েছে রিট।
গোপালগঞ্জের বাসিন্দা হওয়ায় গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ ছিলেন প্রতাপশালী। যেন আইনের ধার ধারতেন না তিনি। নিজের ইচ্ছেমাফিক নিয়ম দিয়েই করেছেন নাবিক নিয়োগ সহ নানা কর্মকাণ্ড। এর ফলে সমুদ্রগামী জাহাজে নাবিক নিয়োগ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা অনিশ্চয়তা। হুমকির মুখে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়। বিদেশে নষ্ট হচ্ছে দেশের সুনাম। দেশের স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে এখনই পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
মো. মনোয়র হোসাইনকে ভুয়া ইন্দোনেশিয়ান সনদের বিপরীতে বাংলাদেশি সার্টিফিকেট অব ইকুইভেলেন্সি নং 2.EC1.000040 প্রদান করা হয়। তার সিডিসি নং সি/ও/৫৬৪৮। আবার আবুল বসর মোহাম্মদ নুরুজ্জামান আকন্দকে ভুয়া ইন্দোনেশিয়ান সনদের বিপরীতে বাংলাদেশি সার্টিফিকেট অব ইকুইভেলেন্সি নং 2.EC1.000038 প্রদান করা হয়। তার সিডিসি নং সি/ও/৪৯০৯। এই জালিয়াতির বিষয়টি উদ্ঘাটন করেন ইঞ্জিনিয়ার শিপ সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার আবুল বাসার।
ফাইল দুটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ ভুয়া ইন্দোনেশিয়ান সনদকে সঠিক বলে প্রত্যায়ন করে এই সনদ দুটি পেতে সহায়তা করেছেন।
জানা গেছে, সম্প্রতি নৌ পরিবহণ অধিদপ্তর ২শ জনের নাম সংবলিত আবেদন পত্র যাচাইবাছাইয়ের জন্য সিএনএস ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ, পরীক্ষক ইঞ্জিনিয়ার আবুল বাসার ও কো-অর্ডিনেটর মিথুন কুমার চাকি সহ তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। প্রক্রিয়াটি ও নামের তালিকা নিয়ে অসঙ্গতির সন্দেহ হলে পরীক্ষক ইঞ্জিনিয়ার আবুল বাসার ও কো-অর্ডিনেটর মিথুন কুমার চাকি ঐ যাচাই বাছাইয়ের রিপোর্টে স্বাক্ষর করেননি। পরে ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ একাই স্বাক্ষর দিয়ে তালিকায় নাম থাকা দুই শত জনের জন্য সুপারিশ প্রদান করেন এবং পরবর্তীতে অনুমোদনও করিয়ে নেন।
ইঞ্জিনিয়ার শিপ সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার আবুল বাসার এ ব্যাপারে বলেন, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর সিডিসি প্রদানের জন্য নাম সম্বলিত আবেদন পত্রগুলো যাচাই বাছাইয়ের জন্য আমাকে কমিটির সদস্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু প্রক্রিয়াটি ও নামের তালিকা নিয়ে অসঙ্গতির সন্দেহ হলে আমি সহ কমিটির দুই জন সদস্য যাচাই বাছাইয়ের রিপোর্টে স্বাক্ষর করিনি। শুধু চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ ভুয়া সুপারিশ করে অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন।
নথি পর্যালোচনা ও তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থী নাবিক (রেটিং) ভর্তির সমন্বিত পরীক্ষা নীতিমালা-২০২২ এবং নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিডিসি প্রদানের নীতিমালা-২০১৮ এর অনুচ্ছেদ ৪ ও ৮ ভঙ্গ করে সম্পূর্ণ নীতিমালা বহির্ভূতভাবে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ২’শ জন অযোগ্যকে নির্বাচিত করেন। এদের জন প্রতি ৭ লাখ টাকা করে মোট প্রায় ১৪ কোটি টাকা অবৈধভাবে নেয়া হয়েছে। প্রি-সী স্পেশাল রের্টং কোর্স নামে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদিত কোনো কোর্স না থাকা সত্ত্বেও অনাবাসিক প্রি-সী স্পেশাল রেটিং কোর্স ২০২৩ চালু করে এবং চট্টগ্রাম ন্যাশনাল মেরিটাইম ট্রেনিং ইনিষ্টিটিউটে প্রশিক্ষণ দেয়। এই প্রশিক্ষণ অনুমতির জন্য আবেদনকারীর পূর্ণ নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্র কিংবা নম্বর ও মোবাইল নম্বর কিছুই নেই। আবেদনপত্রের সাথে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে আগ্রহীদের তালিকাও সংযুক্ত নেই। তাছাড়া বেআইনিভাবে জারি করেছেন পানামা সার্টিফিকেট, বেলিজ সার্টিপিকেট, হালদিয়া সার্টিফিকেট, মালয়েশিয়ান সার্টিফিকেট, ফিলিপাইন সার্টিফিকেট। পাশাপাশি সরকারি ও অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সিডিসি সনদ ধারীরা চাকরি না পাওয়ায় বছরে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার হাতছাড়া হচ্ছে। সরকারকে এই লোকসানে ফেলছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। এসব বিষয়ে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে হাইকোর্টে রিট করলে গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ডি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ ঘটনা তদন্ত করে দুদককে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
জাহাজের নাবিক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে করা হাইকোর্টের রিটে উল্লেখ করা হয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তরে চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) পদে যোগদানের পর ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ অবৈধ দুর্নীতিবাজ শিপিং মাস্টার জাকির হোসেনের সাথে যোগসাজশে নীতিমালাকে উপেক্ষা করে নকল পানামা সিডিসি’র অনুকূলে বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান করে। নীতিমালা বহির্ভূতভাবে অবৈধ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ২শ জন অযোগ্যকে নির্বাচিত করেন। এদের জন প্রতি ৭ লাখ টাকা করে মোট প্রায় ১৪ কোটি টাকা অবৈধভাবে নেয়া হয়েছে। এর ফলে সরকারি ও অনুমোদিত বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে রেটিং কোর্স উত্তীর্ণ কয়েক হাজার নাবিক চাকরি পাচ্ছে না। ভুয়া পানামা সিডিসি প্রাপ্তরা জাহাজে ওঠার পর ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন বন্দরে পালিয়ে যায়। এরফলে জাহাজ মালিকদের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার জরিমানা দেওয়া লাগে এবং পরবর্তীতে তারা জাহাজে বাংলাদেশি নাবিক নিতে অনীহা প্রকাশ কিংবা নিষিদ্ধ করে। আবার কারো কারো কাজের মান খুবই খারাপ হওয়ায় জাহাজ মালিকরা বাংলাদেশি নাবিকদের নিষিদ্ধ করে। এসব কারণে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈধ সিডিসি প্রাপ্ত যোগ্যরা বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে চাকুরি হারাচ্ছে আর বছরে প্রায় ৪’শ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া প্রশিক্ষণের জন্য আবেদনপত্রে আবেদনকারীদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদাভাবে সম্মতিপত্র সংযুক্ত করার বিধান থাকলেও এসব না করেই ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন শুধু ২শ জনের একটি তালিকা দিয়েই ভৌতিকভাবে তা অনুমোদন করিয়ে নেন। নৌপরিবহন অধিদপ্তর এই ২শ জনের নাম সম্বলিত আবেদন পত্রটি যাচাই বাছাইয়ের জন্য সিএনএস ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ, পরীক্ষক ইঞ্জিনিয়ার আবুল বাসার ও কো-অর্ডিনেটর মিথুন কুমার চাকি তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে। প্রক্রিয়াটি ও নামের তালিকা নিয়ে অসঙ্গতির সন্দেহ হলে পরীক্ষক ইঞ্জিনিয়ার আবুল বাসার ও কো-অর্ডিনেটর মিথুন কুমার চাকি যাচাই বাছাইয়ের রিপোর্টে স্বাক্ষর করেননি। পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ একাই স্বাক্ষর দিয়ে দু’শ জনের জন্য সুপারিশ প্রদান করেন এবং পরবর্তীতে অনুমোদনও করিয়ে নেন।
মামলার বাদী নাবিক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, গোপালগঞ্জ বাড়ি হওয়ায় গত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ক্যাপ্টেন মো. গিয়াস উদ্দিন আহম্মদ ক্ষমতার অপব্যবহার করে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরকে নানাভাবে বিতর্কিত করেছেন। এ সংস্থাটিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। এরা স্বার্থের জন্য সকল অনিয়মকে নিজেদের মতো করে জায়েজ করে নিতেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার শাস্তিমূলক বদলি সহ নানা ধরনের হয়রানির মধ্যে পড়তে হতো। ভুয়া সিডিসি প্রদান করে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। পাশাপাশি বঞ্চিত হয়েছেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈধ সিডিসি প্রাপ্ত যোগ্যরা। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশের বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
মন্তব্য করুন