দক্ষিণ অঞ্চলের সাদা সোনা খ্যাত চিংড়িতে ভাইরাসের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। যার ফলে চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকা খুলনা বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ অন্যান্য উপকূলীয় জেলার চিংড়ি চাষিরা এখন উৎপাদন হারাচ্ছে।
জানা গেছে, পোনার মূল্য বৃদ্ধি, অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে প্রায় প্রতিটি ঘেরে বাগদা চিংড়িতে মড়ক দেখা দিয়েছে। মৎস্য ঘেরে এক ধরনের কাটা শ্যাওলার জন্ম হয়ে থাকে, যেটা বাগদা চিংড়ির খাদ্য ও পুষ্টি জোগায়। কিন্তু এ বছর প্রচণ্ড খরায় তা আর কাজে আসছে না। খাদ্যসংকট, অনাবৃষ্টি, অধিক তাপ, প্রাকৃতিক খাদ্যের ঘাটতি, সব মিলিয়ে চিংড়ি চাষিদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
এ ছাড়া সরকার নদী বা সাগর থেকে বাগদা-রেণু পোনা আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় চিংড়িচাষিরা মহাসংকটে পড়ছে। নদীর পোনা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়, কিন্তু হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনায় উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। যার কারণে চাষিরা বার বার ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
স্থানীয় মৎস্য চাষিরা বলছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছরে তাপমাত্রা অনেক বেশি। এপ্রিল থেকে গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে উপকূল। হয়নি কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি। ফলে লবণ-পানির ঘেরগুলোতে লবণাক্ততা বেড়েছে। এতে গত দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ঘেরের চিংড়িতে মড়ক লেগেছে। চাষিরা নতুন করে আর চিংড়ির পোনা ছাড়ছেন না। সবার মাঝে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে।
উপজেলার মহারাজপুরে, মহেশ্বরীপুর, বাগালী, কয়রা, উত্তর বেদকাশী, দক্ষিণ বেদকাশীসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে। অনাবৃষ্টি আর প্রখর রোদে মাছের ঘের আর ছোট-বড় জলাশয়গুলোতে পানি কমে গেছে। অত্যধিক তাপে পানি উত্তপ্ত হয়ে ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মারা যাচ্ছে চিংড়ি মাছ।
কয়রা সদরের চিংড়ি চাষি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমি ৯ বিঘা জমিতে বাগদা চিংড়ির চাষ করি। কিন্তু এ বছরের প্রথম থেকেই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১ সপ্তাহের মধ্যে সব মাছ মরে গেছে।
মাছচাষি ইসমাইল হোসেন বলেন, প্রাকৃতিক পোনা বাগদা চাষিদের জন্য একটি আশীর্বাদ। এই পোনা জীবাণুমুক্ত এবং মৃত্যুর হার কম। পাশাপাশি দ্রুত বর্ধনশীল। সরকার নদী বা সাগর থেকে রেনু পোনা আহরণ নিষিদ্ধ করায় এই সুযোগটাকে কাজে লাগায় হ্যাচারি কোম্পানিগুলো। কিন্তু হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনায় মড়ক লাগে বেশি।
কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের অবসারপ্রাপ্ত অধ্যাপক আ ব ম আব্দুল মালেক বলেন, চিংড়ি চাষে ভাইরাসের আক্রমণে চাষিদের জন্য বড় এক সংকট সৃষ্টি করেছে। চাষিরা তাদের আর্থিক ভবিষ্যতের জন্য খুবই বিপদে আছেন। সরকার এবং মৎস্য বিভাগ দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়, তবে চিংড়িশিল্পে আরও বড় ক্ষতি হতে পারে। চাষিদের সহায়তা এবং ভাইরাস রোধে দ্রুত সমাধান খুঁজে বের করা জরুরি।
কয়রা উপজেলা সিনিয়র মৎস কর্মকর্তা সমীর কুমার সরকার কালবেলাকে বলেন, তাপমাত্রা প্রাণীর জন্য একটা বড় সমস্যা। চাষিরা কেউ মৎস অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী মাছ চাষ করে না। স্বাভাবিক একটি মৎস ঘেরে ৩ ফুটের উপরে পানি রাখতে হবে। কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, মৎস ঘেরগুলোতে ১ ফুটেরও কম পানি। যার ফলে সূর্যের তাপ সরাসরি আড়াই ফুট পর্যন্ত পানির নিচে প্রবেশ করে। তখন মাটির তাপমাত্রাও বেড়ে যায়, আবার খাবারেরও সংকট থাকতে পারে। এ কারণে অতিরিক্ত তাপ মাছ সহ্য করতে না পেরে মারা যায়।
তিনি বলেন, একবার কোনো মৎস্য ঘেরে ভাইরাস ঢুকলে তার বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর হয় না। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে নয়। চাষিরা ঘেরের পানি ও মাটি নিয়ে এলে আমরা তা পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে প্রস্তুত আছি।
মন্তব্য করুন