ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কমিশনার মাহবুবুর রহমান দুলালের মালিকানাধীন অবৈধ চিড়িয়াখানা সিলগালা করেছে বনবিভাগ। এ সময় বিভিন্ন প্রজাতির ২৩টি বন্যপ্রাণী জব্দ করেছে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
সম্প্রতি চিড়িয়াখানার ভেতরে থাকা একটি ভালুকের শরীরে পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়ালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ঘটনাটি জানতে পেরে অভিযান পরিচালনা করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৪টায় অবৈধভাবে পরিচালিত চিড়িয়াখানাটিতে অভিযান চালায়। এ সময় সরকারি অনুমোদন না নিয়ে মিনি চিড়িয়াখানায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণের অভিযোগে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২-এর ৩৪-এর খ ধারা লঙ্ঘন করায় চিড়িয়াখানায় থাকা বন্য প্রাণী জব্দ করেন।
ইতোমধ্যে প্রাণীটির পায়ের অংশবিশেষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চিড়িয়াখানা পরিচালনাকারীদের কাছ থেকে খবরে পেয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের সার্জারি ও অবস্টেট্রিক্স বিভাগের অধ্যাপক মো. রফিকুল আলম ভালুকটি দেখতে আসেন। অন্য ভালুকটির শরীরেও রোগ ছড়াতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি অসুস্থ ভালুকটিকে অন্যত্র স্থানান্তরের পরামর্শ দেন।
ময়মনসিংহ মিনি চিড়িয়াখানায় দেশি-বিদেশি ১১৪টি প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে কুমির, ময়ূর, অজগর, হরিণ, মদনটাক, ধনেশ, লজ্জাবতী বানরসহ দেশীয় ৪৮টি প্রাণীকে জব্দ করা হলেও পুরো মিনি চিড়িয়াখানাকে সিলগালা করা হয়। এর মধ্যে ২৭টি প্রাণী জব্দ করে নিয়ে গেলেও ২১টি প্রাণী চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের জিম্মায় এবং বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়া হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এ অভিযান চলে। শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়নি অসুস্থ ভালুক দুটিকে। চিড়িয়াখানায় রেখে ভালুক দুটিকে চিকিৎসা করা হবে।
উল্লেখ্য, জয়নুল আবেদিন উদ্যানের ভেতরে ২০১৩ সালে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় মিনি চিড়িয়াখানাটি গড়ে তোলা হয়। সিটি করপোরেশন থেকে মেসার্স সেলিম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান চিড়িয়াখানার জমিটি বরাদ্দ নিয়েছিল। দীর্ঘ ১২ বছর যাবত এই চিড়িয়াখানাটি তৎকালীন মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটুর অনুসারী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের ৪নং ওয়ার্ড কমিশনার মাহবুবুর রহমান দুলাল পরিচালনা করে আসছিল।
চিড়িয়াখানার কর্মচারী কামাল হোসেন বলেন, সাবেক মেয়র (ইকরামুল হক) বেশির ভাগ সময় প্রাণীর ব্যবস্থা করতেন। বেশির ভাগ প্রাণী ঢাকা থেকে আনা হতো। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকলেও সাবেক মেয়র ও কাউন্সিলর কীভাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজনের নামে লাইসেন্স নিলেও চিড়িয়াখানাটি চালাতেন তারাই (সাবেক মেয়র ও কাউন্সিলর)। অনেক লোক আছে ঢাকা থেকে এসে প্রাণী দিয়ে যান।
তিনি বলেন, আমরা জানি শুধু লাইসেন্স আছে। কিন্তু কত সালে লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে, এসব জানি না। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তারা গা ঢাকা দেয় এবং চিড়িয়াখানাটির দায়িত্ব নেন ৪নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান মামুন।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে মিনি চিড়িয়াখানার পরিচালক মিজানুর রহমান মামুন জানান, মানুষের চিত্ত বিনোদনের কথা চিন্তা করে নামমাত্র দর্শনার্থী বিনিময় মূল্যে চিড়িয়াখানায় দেখভাল করেন। তারা প্রাণীদের প্রতি সর্বোচ্চ যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে সম্প্রতি একটি ভালুক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অসুস্থ হলে তার পায়ে পচন ধরে এবং ঘা হয়ে যায়। তবে তারা একজন ভেটেরিনারি চিকিৎসকের মাধ্যমে সেটি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক নার্গিস সুলতানা জানান, বন্যপ্রাণী সংগ্রহ, দখলে রাখা, প্রদর্শন ও সংরক্ষণ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তাই এখান থেকে ২৩টি বন্যপ্রাণী জব্দ করা হয়। জব্দ প্রাণীগুলোকে গাজীপুর সাফারী পার্কে অবমুক্ত করা হবে এবং কিছু প্রাণীকে ১৫ দিন কোয়ারেন্টিনে রেখে স্বাভাবিক বন্য পরিবেশে অবমুক্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা রথীন্দ্র কুমার বিশ্বাস বলেন, আইন অমান্য করে ব্যক্তির প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে চিড়িয়াখানাটি গড়ে তোলা হয়েছিল। খবর পেয়ে প্রাণীগুলোকে উদ্ধার করা হয় এবং আহত ভালুকটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চিড়িয়াখানার কর্মচারী রনি মিয়া বলেন, আমি চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলোর দেখাশোনা করি। ভালুক দুটির বয়স কত, সে সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। তবে আমি শুনেছি এগুলো ২০১৩ সালে ছোট অবস্থায় আনা হয়। তখন ঘর ছোট ছিল। কিন্তু প্রাণীগুলো বড় হলেও ঘর বড় হয়নি। দুটি ভালুকই পুরুষ। দুটি ভালুক প্রায়ই একে অন্যকে আক্রমণ করে।
তিনি আরও বলেন, ২০ দিন আগে একটি ভালুকের পা কামড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে অন্যটি। তারপর স্থানীয় প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ভালুকের পায়ের ক্ষত বাড়ছে।
চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসা সাফি আহমেদ নামে এক দর্শনার্থী বলেন, অসুস্থ ভালুকটি দেখে অনেক দর্শনার্থীর মন খারাপ হয়। সেটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া উচিত।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের সচিব সুমনা আল মজিদ বলেন, চিড়িয়াখানার জন্য সিটি করপোরেশন শুধু জমি বরাদ্দ দিয়েছে। সেখানকার প্রাণীর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নয়। তারা যদি প্রাণীদের সুরক্ষা দিতে না পারে ও চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে, তাহলে ইজারা বাতিলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন