ছাড়পত্র বা অনুমতি নেই। আশপাশে রয়েছে বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও হাটবাজার। তবু চলছে ইটভাটা। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলায় সব কটি ইটভাটাই চলছে অনুমোদনহীনভাবে। তবু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফসলি জমি ও বসতবাড়ির আশপাশে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা।
আর ভাটাগুলোতে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে দেশীয় নিম্নমানের কাঠ। বাড়ছে পরিবেশের দূষণ, উর্বরতা হারাচ্ছে কৃষি জমি। তবু রহস্যজনক কারণে বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ ভাটা।
আর এদিকে আদালত ও পরিবেশ উপদেষ্টার কঠোর হুঁশিয়ারির পর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নাজিরপুরের প্রশাসন শুধু একটি ইটভাটায় ১ লাখ টাকা জরিমানা করেই ক্ষান্ত।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলায় ২টি ইটভাটা রয়েছে। ভাটাগুলো ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইনের তোয়াক্কা না করেই পরিচালিত হচ্ছে। বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে ফসলি জমিতে। আশপাশে রয়েছে বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও হাটবাজার। আবার নিয়মনীতির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কয়লা ও কাঠ। উপজেলার ২নং মালিখালি ইউনিয়নে একেবারে নিভৃত পল্লীতে ১টি ইটভাটা ও ১নং মাটিভাংগা ইউনিয়নের শেষ প্রান্তে দুটি ইটভাটা রয়েছে।
স্থানীয়দের সরকারি কবুলিয়তপ্রাপ্ত সম্পত্তি দখল করে চলছে এ ইটভাটা। এমন অভিযোগ উঠেছে নাজিরপুরের ২নং মালিখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সাবেক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. রুহুল আমিন বাবলু দাড়িয়ার বিরুদ্ধে। চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলছে মেসার্স রনি ব্রিকস নামের একটি ভাটা।
ভাটার পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা জানান, বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাটবাজারের পাশেই গড়ে ওঠা এসব ভাটায় ইট প্রস্তুতে এলাকার কৃষকের জমির টপসয়েল (উপরি ভাগের মাটি) কিনে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসলি জমি। অর্ধেকের বেশি জমির মাটি গিলে ফেলেছে ভাটাগুলো। প্রতিনিয়ত ভাটার ধোঁয়া ও কয়লা-ধুলাবালির দূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে স্থানীয়রা। পাশাপাশি ফলদ ও গাছপালার ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ হারাচ্ছে বৈচিত্র্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন জানান, আবাদি জমি লিজ নিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা আইন না মেনেই ইটের ভাটা গড়ে তুলেছে। কাঠ, কয়লা দিয়ে দেদার ইট পোড়াচ্ছে। এসব ভাটা মালিকের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে পারে না। বলতে গেলে চাঁদাবাজির মামলার হুমকি দেয়। নতুবা নিজস্ব বাহিনী দিয়ে হয়রানি করে। আর প্রশাসনে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করেই ভিতরে ভিতরে চালাচ্ছে এসব ইটভাটা। নামমাত্র অভিযান চালিয়ে কিছু জরিমানা করে প্রশাসন চলে যায়, তারা তাদের মতো ভাটা চালাচ্ছেই।
তারা আরও বলেন, ইটভাটা আমাদের সর্বনাশ করে ফেলছে। ইটভাটার কারণে গাছে কোনো ফল ধরে না। ধরলেও আকারে তা বাড়ে না। বিশেষ করে শীতের শেষের দিকে ভাটার ঝাঁঝালো গন্ধে শিশু নিয়ে বাসায় থাকা খুব মুশকিল। শিশুদের ঠাণ্ডা লেগেই থাকে এ গন্ধে। কিন্তু কাকে বলব, এসব ভোগান্তির কথা। আমরা ইটভাটা বন্ধের জোর দাবি জানাচ্ছি।
নাজিরপুর উপজেলার ২নং মালিখালি ইউনিয়নের মালিখালি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মালিখালি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং পাশেই রয়েছে কয়েকটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর পাশেই রনি ব্রিকস নামে ইটভাটা গড়ে ওঠে।
অপরদিকে ১নং মাটিভাংগা ইউনিয়নের বানিয়ারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দিঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং আরওঅনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই গড়ে উঠেছে জয় ব্রিকস নামে ইটভাটা।
আবার মাঘ-ফাল্গুন মাসে তো কয়লা পোড়ানোর গন্ধে শ্বাস নেওয়া জুলুম হয়, বিশেষ করে শ্বাসকষ্টের রোগীদের সমস্যা খুব বেড়ে যায়। আমাদের এখানে ফসলি জমির ওপর আওয়ামী লীগের দাপট দেখিয়ে হাসিনার আমলে ইটভাটা স্থাপন করে। কিন্তু হাসিনা পালানোর ৭ মাস পরও কীভাবে কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভাটা চালাচ্ছে তা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সবাই জানে। আমরা এসব ভাটা বন্ধের দাবি জানাচ্ছি।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, গত বছর মেসার্স রনি ব্রিকসের কালো ধোঁয়ায় ৭ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে কৃষকের এবং ওই এলাকায় কোনো ধরনের ফল চাষ করা যাচ্ছে না। মেসার্স জয় ব্রিকসের কালো ধোঁয়ায় এ বছর নষ্ট হচ্ছে রবি মৌসুমের ফসল সূর্যমুখী। ভাটা চালু হবার পর থেকে প্রতি বছর নষ্ট হচ্ছে আশপাশের ধান।
সরেজমিনে মেসার্স রনি ব্রিকসে গেলে ইটভাটার মালিক পক্ষ দেখাতে পারেননি কোনো কাগজপত্র। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ২০২৩ সালেই হয়েছে মেয়াদ উত্তীর্ণ। জেলা প্রশাসক কর্তৃক লাইসেন্সের মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়েছে ২০১৩ সালে।
এ ব্যাপারে ইটভাটা দুটির মালিকদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইসরাতুন্নেছা এশা অবিলম্বে এ ইটভাটা বন্ধের দাবি জানিয়ে বলেন, ইটভাটায় হেক্টর হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। এতে কৃষকের সব ইনভেস্ট জলে যাচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফজলে রাব্বি কালবেলাকে বলেন, নাজিরপুরে দুটি ইটভাটা রয়েছে। একটিতে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। আমরা রনি ব্রিকসের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যের জায়গা দখল করছে। ওই ইটভাটায় আবারও অভিযান পরিচালনা করব।
মন্তব্য করুন