কুমিল্লার মুরাদনগরে ওসির রুমের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রমিক দল নেতাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাজিব নামে এক স্থানীয় নেতা। যিনি আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ।
সোমবার (২৪ মার্চ) রাতে এ ঘটনা ঘটে। এদিকে স্থানীয় মানুষের মাঝে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে যে, ওসির কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে হুমকি দেওয়ার সাহস পেল কোথায়? তা ছাড়া ঘটনার সমাধানে দায়িত্বরত সেনাবাহিনী, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের নিয়ে বৈঠকে বসলেও তা সমাধান হয়নি। বরং দুটি মামলা করা হয়েছে।
এই মামলায় বৈঠকে উপস্থিত বিএনপি নেতাদেরও আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অবিলম্বে এ ঘটনার সমাধান না হলে যে কোনো মুহূর্তে আরও গোলযোগের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
ঘটনা প্রসঙ্গে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী জানান, অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ কোম্পানিগঞ্জ সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে সিরিয়ালের বাহিরে গাড়িতে গ্যাস নিতে গেলে আগে থেকেই লাইনে থাকা চালকরা বাধা দেন। পরে ওই ব্যক্তি নিজেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টার চাচাতো ভাই পরিচয় দেন এবং ক্ষিপ্ত হয়ে তার অনুসারীদের ডেকে এনে স্ট্যান্ডের কেরানি আবুল কালাম ও চালকদের মারধর করে কেরানিকে চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে পুলিশে দেন।
সোমবার সন্ধ্যায় মুরাদনগর উপজেলার কোম্পানিগঞ্জ টার্মিনালে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই আবুল কালামের মুক্তির দাবিতে মুরাদনগর থানার সামনে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ সময় পরিবহন শ্রমিকদের চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে মুরাদনগর থানার ওসির কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে শ্রমিক নেতাকে টেনে ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দেন ওবায়েদ উল্লাহর ডাকে আসা মুরাদনগর সদর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ছাত্রলীগের সেক্রেটারি সাজিব।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মুরাদনগর থানার সামনে সেনাবাহিনী, অতিরিক্ত পুলিশ ও প্রশাসনের একাধিক সংস্থার সদস্য অবস্থান নেন। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে স্থানীয়রা। সোমবার রাত ৮টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত মুরাদনগর সদর এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
স্থানীয় এক ফল ব্যবসায়ী বলেন, কুমিল্লা থেকে পুলিশ, সেনাবাহিনী, ডিবি পুলিশ এসে যেভাবে পুরো মুরাদনগর সদরে অবস্থান নিয়েছে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের শাসন আবার ফিরে আসছে। তিনি বলেন, এই ঘটনার দ্রুত সমাধান না হলে আবার গোলযোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েই যাবে।
বিক্ষুব্ধ পরিবহন শ্রমিকরা জানান, অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ তার বাড়ি মুরাদনগরের আকবপুরের বাড়িতে যাওয়ার জন্য কোম্পানিগঞ্জ টার্মিনালের সিএনজি স্ট্যান্ডে আসেন। এ সময় তিনি সিরিয়াল ছাড়াই গাড়িতে গ্যাস নিতে চাইলে অন্য চালকরা বাধা দেন। পরে চালকদের অকথ্য ভাষায় গালমন্দ ও হুমকি-ধামকি দিয়ে সিরিয়ালের বাহিরে সিএনজিতে গ্যাস নিতে চাইলে নিতে দেননি সিএনজিচালকরা। একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয় অ্যাডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ ফোন দিয়ে ডেকে আনেন তার অনুসারীদের। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের সমর্থক ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মীর উপস্থিতি দেখা যায়।
ওবায়েদ উল্লাহ তার অনুসারীদের নিয়ে সিএনজি স্ট্যান্ডের কেরানি ও চালকদের মারধর করেন। পরে কেরানিকে আটকে চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে পুলিশে দেন তারা। পুলিশের সামনেই সিএনজিচালকদের মারধর করে ওবায়েদ উল্লাহর সমর্থকরা।
মারধরের শিকার সিএনজিচালকরা বলেন, কোম্পানিগঞ্জ থেকে নগরপাড় সড়কে আমরা সিরিয়াল মেনে গাড়ি চালাই। আজ একজন আসে সিরিয়ালের বাহিরে সিএনজি নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরা তাকে যেতে না দেওয়ায় সে আমাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে আমরা তাকে চিনি কিনা। আমরা না বলায় তিনি তার লোকজন নিয়ে এসে আমাদের মারধর করে চাঁদাবাজ দাবি করে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় আমাদের স্ট্যান্ডের সিএনজির সিরিয়াল লেখক আবুল কালামকে চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে মিছিল ও পুলিশে সোপর্দ করেন। আমরা তার মুক্তির দাবিতে মুরাদনগর সদরে অবস্থান করেছি।
এদিকে মধ্যরাতে বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিলে ধাওয়া দিয়ে ৫ জনকে আটক করে নিয়ে আসে কুমিল্লা ডিবি পুলিশ। পুলিশের এমন একমুখী আচরণে স্থানীয়রা ক্ষুব্ধ। তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর যেখানে পুলিশের আচরণ পরিবর্তন হওয়ার কথা সেটি কিন্তু হয়নি। আমরা অবিলম্বে আটকদের মুক্তি দাবি করছি।
এদিকে উক্ত ঘটনার সমাধানে মুরাদনগর থানার ওসির রুমে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সালিশে বসা বিএনপি নেতাদের নামেও মামলা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মহিউদ্দিন অঞ্জন বলেন, কোম্পানিগঞ্জে সিএনজিচালকদের সঙ্গে উপদেষ্টার চাচাতো ভাইয়ের ঝামেলা হয়েছে। সে খবরে আমরা সমস্যার সমাধানে থানায় যাই। সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও ওসির সঙ্গে সমস্যা সমাধানে মিটিং করি। অথচ আজকে দেখলাম আমাকে এবং আমার সঙ্গে থাকা কয়েকজন বিএনপি নেতাকেও মামলায় জড়িয়েছে। অবাক করা বিষয়! এমন মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা তো আওয়ামী লীগের আমলে হতো! এখনো কি ফ্যাসিবাদ রয়ে গেল?
উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাবেক চেয়ারম্যান মোল্লা মজিবুল হক বলেন, ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা হয়েছে। আর আমরা আমাদের নেতা সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের নির্দেশে থানার নিরাপত্তা দিলাম। নিজেরা রান্না করে তাদের এক মাস খাবার দিলাম। অথচ সেই পুলিশ এখন ফ্যাসিবাদের ভূমিকা পালন করছে। উপকারের এ প্রতিদান দিল?
মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুর রহমান বলেন, মুরাদনগর থানায় দুটি পৃথক মামলা হয়েছে। থানায় হট্টগোল করায় মুরাদনগর থানার এসআই আলী আক্কাস ৩২ জনের নাম উল্লেখ ও ৭০-৮০ অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। অপরটি আকুবপুর ইউনিয়নের আবুল ফয়সাল তাদের মারধর করায় ৩২ জনের নাম উল্লেখ ও ৭০-৮০ অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। এই দুই মামলায় এখন ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করেছে পুলিশ।
মন্তব্য করুন