২৩ বছর আগে একটি দেওয়ানী মামলা করে এখন বিপাকে পড়েছেন মুজিবনগরের ভুক্তভোগী ভূমি মালিক ইন্নাল শেখ। দীর্ঘ দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরে ঘুরে তৃতীয় দফার একতরফা শুনানি ও রায়ের দিন জানতে পারলেন- প্রাক্তন উকিলের মুহুরির দ্বারা জমির দলিল গায়েব।
মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলে ও নথি ঘেঁটে দেখা যায়, দীর্ঘ ২৩ বছর আগে ২০০২ সালের ৩১ মার্চ মেহেরপুরের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে বিবাদী মো. মিন্টু জোয়ারদারের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলাটি করেন ইন্নাল শেখ। সমন জারি ও জবাব দাখিলে বিবাদী পক্ষের অনুপস্থিতিতে বছরের পর বছর চলে যায়। দীর্ঘদিন মামলা চলাকালে আদালতে বিবাদীপক্ষের অনুপস্থিতির কারণে আদালত ইন্নাল শেখের অনুকূলে একতরফা রায় দেন। এরপর আবার বিবাদী পক্ষ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপিল করে। এরপর আবারও যথারীতি অনুপস্থিত থাকলে আপিলেও একতরফা রায় পান ইন্নাল শেখ। এরপর আবারও বিবাদী পক্ষের অনুপস্থিতির কারণ দেখিয়ে একটি মিস কেস করেন মো. মিন্টু জোয়ারদার। এরপর থেকে আদালতে যথারীতি অনুপস্থিত থাকতে শুরু করেন।
দেওয়ানি মামলাটি দীর্ঘদিন ধরে আদালতে নিষ্পত্তি না হওয়ায় বাদীপক্ষ পরিবর্তন করেন আইনজীবী। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া মেনে জেলা আইনজীবী সমিতির এনওসির মাধ্যমে ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর আইনজীবী পরিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এরপরই বাধে বিপত্তি। আদালতে পুনরায় মামলাটির একতরফা শুনানির সময় দেখা যায় মামলার মূল নথিতে জমির দলিলটি নেই। অথচ এর আগে দু-দুবার সেই দলিলের সূত্র ধরেই আদালত ইন্নাল শেখের পক্ষে একতরফা রায় দিয়েছিলেন।
মামলার বাদী ইন্নাল শেখ কালবেলাকে বলেন, আমার বৈধ সম্পত্তি নিয়ে বিবাদী পক্ষ আমাকে বিগত ২৩ বছর যাবত আদালতের বারান্দায় রেখেছে। অথচ বিবাদী পক্ষ কখনো আদালত না এসে আদালত অবমাননা করে চলেছে। আমার মামলার প্রাক্তন আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বারের মুহুরি নুরুলের সঙ্গে বিবাদী পক্ষের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। মুহুরির সঙ্গে আত্মীয়তা ও বিবাদীর পয়সায় মামলার কাগজপত্র হারানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। কারণ এনওসির মাধ্যমে আইনজীবী পরিবর্তন করার পরও ২২ মার্চ থেকে অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার ও তার মুহুরি বারবার আমার মোবাইলে কল দিয়ে একতরফা সাক্ষী ও রায় হবে জানিয়ে টাকাসহ যোগাযোগ করতে বলে।
আইনজীবী পরিবর্তনের পরও প্রাক্তন আইনজীবী ও তার মুহুরির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে। ঘটনা শুনে আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মারুফ আহমেদ বলেন, এই মুহূর্তে আমি জরুরি কাজে ঢাকায় আছি। মেহেরপুরে ফেরার পর বিষয়টি আমি দেখব।
আর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রাজ্জাক টোটন বলেন, ভুক্তভোগী বিষয়টি নিয়ে আইনজীবী সমিতিতে অভিযোগ দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইন্নাল শেখের ছেলে মুজাহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, আমরা মামলার নথিগুলো তুলে বেশ কয়েকজন অ্যাডভোকেটকে দেখাই। এটা জানার জন্য, আমাদের মামলার গ্রাউন্ড কী। যেহেতু দীর্ঘদিন যাবত আমার বাবা মামলা পরিচালনা করে আসছেন, তাই সেটা জানার পর ২৩ সালের ৩০ মে আদালতের যেদিন ছিল, ওদিন নুরুল মুহুরির কাছে নথি (জমির মূল দলিলপত্র) দিয়েছি কোর্টে জমা করার জন্য। কোর্টের নিচতলায় তিনি বলেন, আমার হাতে দাও আমি জমা করে দেব। এর কয়েক মাস পরে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, নথি জমা দিয়েছি। আদতে তিনি সেই নথি জমা দেননি। আজকে যখন জানতে পারলাম যে নথি কোর্টে জমা হয়নি, তখন বারবার নুরুল মুহুরিকে কল দিলে তিনি অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
মুজাহিদুল ইসলাম আরও বলেন, আমরা বাদী পক্ষ মনে করছি- অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বারের কাছ থেকে মামলা সরিয়ে অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফার কাছে আইনগতভাবে হস্তান্তর করায় তিনি মুহুরিকে নিয়ে বাদী পক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে আমাদের মামলার নথিগুলো গায়েব করেছেন। আমরা কোর্ট ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করব বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত করে আমাদের ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা প্রদান করার জন্য।
এ বিষয়ে কালবেলার পক্ষ থেকে নুরুল মুহুরির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি বলেন, ‘আজ সকালে আমি আদালতের মূল নথিতে দলিলটি জমা করেছি।’ মুহুরির এই কথোপকথনের অডিও রেকর্ড কালবেলার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
পরবর্তীতে আদালত জমির দলিল মামলার নথিতে না পেয়ে পরবর্তী তারিখে জমির দলিল দাখিল করার নির্দেশ দিলে আবারও যোগাযোগ করা হয় মুহুরির সঙ্গে। এ সময় তিনি কোনো কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তিনি অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
উল্লেখ্য, ভূমি বা জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মানুষকে বিচিত্র ভোগান্তি পোহাতে হয়। অনেকে বলেন, দেওয়ানি মামলার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। প্রযুক্তির যুগেও সমন জারি ও জবাব দাখিলে বছরের পর বছর চলে যায়। একপক্ষের গরহাজিরায় মামলা একতরফা নিষ্পত্তি হয়। অন্যপক্ষ এসে আবার মামলা পুনরুজ্জীবিত করে। আপিল শুনানি ও শেষ হওয়ার পরও একই অবস্থা হয়। ফৌজদারি বিচারে কত দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র, বিচার করতে হবে সেটি বলা আছে। কিন্তু দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই।
এছাড়াও এক ব্যক্তির জমি অন্যের নামে নামজারি করা, উত্তরাধিকার সম্পত্তির নামজারিতে জটিলতা, বেঁধে দেওয়া সময়ে নামজারি সম্পন্ন না হওয়া, ভূমি জরিপের ক্ষেত্রে নানারকম নয়-ছয় করা ইত্যাদি সাধারণ ঘটনা। ভূমি অফিসের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালের যোগসাজশে নানা দুর্নীতি, ঘুষ ও আর্থিক কেলেঙ্কারি তো আছেই। সবমিলিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য ভূমির মালিকানা অর্জনের চেয়ে ভূমি রক্ষা করাটাই যেন কঠিন। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ১৫ লাখ, হাইকোর্টে ৮৯ হাজার এবং আপিল বিভাগে ১১ হাজারের বেশি দেওয়ানি মামলা বিচারাধীন ছিল।
মন্তব্য করুন