ঝালকাঠি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫, ০৯:০১ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

ঝালকাঠিতে আমু ঘনিষ্ঠ রসুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

আব্দুল মান্নান রসুল। ছবি : সংগৃহীত
আব্দুল মান্নান রসুল। ছবি : সংগৃহীত

ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল মান্নান রসুল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।

অভিযোগ রয়েছে, আমুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সেই প্রভাব খাটিয়ে ঝালকাঠির আদালতপাড়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন রসুল। আমুর প্রভাবেই তিনি পাঁচবার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি এবং বিনা ভোটে ১১ বার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আদালতে জামিন থেকে শুরু করে নিয়োগ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা, এমনকি স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি নিয়ন্ত্রণেরও অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেউ রসুলের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো। এমনকি আইনজীবীরাও তার মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পাননি। আমির হোসেন আমুর পছন্দে রসুল জেলা পরিষদের সদস্যও হন। অবৈধভাবে আয় করেন কোটি কোটি টাকা। এই টাকায় নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন বাংলো বাড়ি ও মাদ্রাসা। ক্ষমতার প্রভাবে কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের নিজ গ্রাম গোবিন্দধবলের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘আমুনগর’।

তবে ৫ আগস্টের পর উল্টে যায় সবকিছু। ছাত্র-জনতা জ্বালিয়ে দেয় শহরের রোনাল্ডস রোডের আমির হোসেন আমুর বাসভবন। আমুর ভবনের পাশেই মান্নান রসুলের বাড়িতেও হামলা হয়। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান রসুল। পরে তার নামে ঝালকাঠি থানায় বিএনপি অফিসে হামলা ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে ও দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় ছয়টি মামলা হয়। সাড়ে সাত মাস আত্মগোপনে থাকার পর গত ১৬ মার্চ ঝালকাঠির আদালতে আত্মসমর্পণ করলে জেলা ও দায়রা জজ আদালত আব্দুল মান্নান রসুলকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

রসুলের আদালতে আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজিত জনতা ঝালকাঠির আদালতপাড়ায় হাজির হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে আদালতপাড়ায় নিয়োগ করা হয় বাড়তি পুলিশ।

রসুলের উত্থান যেভাবে : ঝালকাঠির একাধিক আইনজীবী ও ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল মান্নান রসুলের (৭৫) বাবা ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্ত্তিপাশা ইউনিয়নের গোবিন্দধবল গ্রামের মুজাফফর ভেন্ডার ঝালকাঠি সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের ডিড রাইটার ছিলেন। রসুলও তার বাবার সঙ্গে ডিড রাইটারের কাজ করতেন। ১৯৮৫ সালে আব্দুল মান্নান রসুল আইনজীবী হিসেবে ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতিতে তালিকাভুক্ত হন। থাকতেন শহরের রোনাল্ডস রোডে তার বাবার কেনা বাড়িতে। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে আমির হোসেন আমুকে একটি বাড়ি কেনায় সহায়তা করার মাধ্যমে তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন রসুল।

অভিযোগ রয়েছে, ঝালকাঠি সরকারি কলেজের প্রফেসর সন্তোষ কুমার রায়ের ওই বাড়ি আমুর নামে দলিল করাতে নেওয়া হয় নানা কৌশল। আমু সেখানে নির্মাণ করেন তিনতলা ভবন। ঝালকাঠি এলে আমু এই বাড়িতে থাকতেন। আমির হোসেন আমু এবং আব্দুল মান্নান রসুলের বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় মাঝখানের দেয়াল ভেঙে পকেট গেট তৈরি করা হয়। ওই গেট দিয়ে যখন তখন দুই পরিবারের লোকজন যাতায়ত করত।

আমুর দুপুর ও রাতের খাবার যেত রসুলের বাসা থেকে। আমুর সঙ্গে রসুলের এমন ঘনিষ্ঠতার কারণে রসুলের বিপক্ষে আমুর সামনে টুঁ শব্দটিও করতে সাহস পেত না আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমির হোসেন আমু প্রথমে ভূমিমন্ত্রী ও পরে খাদ্যমন্ত্রী হন। আমুর পছন্দের লোক আব্দুল মান্নান রসুলকে বানানো হয় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)।

ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির একাধিক সদস্য বলেন, আব্দুল মান্নান রসুল অ্যাডভোকেট হলেও তিনি সাত ধারার মামলাও লিখতে পারতেন না। অথচ আমুর পছন্দের লোক হওয়ায় যোগ্যতাসম্পন্ন অ্যাডভোকেটদের বাদ দিয়ে তাকে দেওয়া হয় পিপির মতো স্পর্শকাতর পদ। মাঝে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারলে পিপির পদ হারান রসুল। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে পিপির পদে ফেরেন তিনি। সেই থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা চার মেয়াদে তিনি পিপির পদ আঁকড়ে ছিলেন।

অভিযোগের শেষ নেই : ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি এবং জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে আব্দুল মান্নান রসুল মোট পাঁচবার পিপি ছিলেন। তিনি আমির হোসেন আমুকে তার বাবা বলে পরিচয় দিয়ে সমাজে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করতেন। আমুর প্রভাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন।

২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১১ বার জোরপূর্বক আইনজীবী সমিতির সভাপতির পদ দখল করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রতি বছর আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের তারিখ এলেই তিনি দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে আাইনজীবী সমিতি ঘিরে রাখতেন, যাতে কোনো আইনজীবী নমিনেশন ফরম কিনতে না পারেন। নমিনেশন ফরম কেনায় ২০১৩ সালে তিনি আইনজীবী সমিতির বিএনপিপন্থি ১০ আইনজীবীর নামে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেন।

এ ছাড়া রসুল যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করে থানার ওসিদের কাছে পাঠাতেন গ্রেপ্তার করার জন্য। পুলিশ রসুলের তালিকা অনুযায়ী বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি করত।

শাহাদাৎ হোসেন আরও অভিযোগ করেন, ২০১৯ সালে জেলা পরিষদের সদস্য হয়ে রসুল জেলা পরিষদ থেকে কাল্পনিক প্রকল্প তৈরি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ক্ষমতার প্রভাবে ঝালকাঠি পৌর আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে আদালতে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেই তিনি চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে আমুর নাম করে চাকরির আশ্বাস দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন।

ঝালকাঠি আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান মুবিন বলেন, ‘ছোটখাটো বিষয়ে অভিযোগ তৈরি করে রসুল ভিন্নমতের আইনজীবীদের শোকজ এবং সদস্যপদ স্থগিত করে আইনজীবীদের পেটে লাথি মারতেন। আবার অনেকের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করতেন। অবৈধ আয় দিয়ে তিনি গ্রামে বাগানবাড়ি, গরুর খামার এবং ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনেছেন। ৫ আগস্টের পর তার বিরদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। আমরা চাই এসব মামলায় তার বিচার হোক।’

৫ বারের পিপিকে এখন দাঁড়াতে হচ্ছে কাঠগড়ায় : আব্দুল মান্নান রসুলের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মো. হুমায়ুন কবীর বাবুল বলেন, ‘রসুলকে ক্ষমতার নেশায় পেয়েছিল। আমির হোসেন আমুর আশকারায় তিনি ১১ বার আইনজীবী সমিতির সভাপতি হয়েছেন। যারা বিরোধিতা করেছে তাদের হয়রানি করেছেন। আমরা তাকে অনুরোধ করে বলেছিলাম এতবার সভাপতি হওয়ার দরকার কী? একবার দুবার হলেই তো সারা জীবন বোর্ডে নাম থাকবে। আমাদের কথা তিনি শোনেননি। যে কোর্টে তিনি ৫ বার পিপি ছিলেন, সেই কোর্টে তাকে আসামি হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। এটা সব আইনজীবীর জন্য লজ্জার।’

ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মাহেব হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের পর আব্দুল মান্নান রসুলের নামে ঝালকাঠি থানায় ৬টি ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, জেলা আইনজীবী সমিতিতে বোমা হামলা ও জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও জেলা আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি শাহাদাৎ হোসেনের ব্যক্তিগত চেম্বার ও বাসা ভাঙচুর, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার মিছিলে হামলা, মহিলা দলনেত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে। মামলাগুলোর বাদী বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।

এসব মামলায় তিনি গত সাড়ে সাত মাস পলাতক ছিলেন। সম্প্রতি তিনি হাইকোর্ট থেকে ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন লাভ করেন। জামিনের মেয়াদ শেষ হলে তিনি ১৬ মার্চ জেলা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, ‘এসব মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা আশা করি খুব শিগগির এসব মামলায় তদন্ত শেষে পুলিশ চার্জশিট প্রদান করবে। সাক্ষ্য-প্রমাণে এসব মামলায় আব্দুল মান্নান রসুলের সাজা হতে পারে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইরাককে টুকরো টুকরো করতে চাইছে ইরান, কী করবে যুক্তরাষ্ট্র?

নিয়ন্ত্রক সংস্থার আশীর্বাদ ছাড়া দুর্নীতি হতে পারে না : বিএপিএলসি সভাপতি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সিলেটের আহ্বায়ক আক্তারের জামিন

নিখোঁজের তিনদিন পর নদীতে পাওয়া গেল নিরবের লাশ

হয়লুন্দের  ‘সিউ’ উদযাপন নিয়ে রোনালদোর অভূতপূর্ব প্রতিক্রিয়া! 

শিল্পকলার বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতা ও দুর্নীতির অভিযোগ

২২ দিনে এলো ২৯ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স

বরিশালে ইমামদের নিয়ে ব্যতিক্রমী ইফতার মাহফিল

ময়মনসিংহে ট্রাক-মোটরসাইকেল সংঘর্ষে নিহত ২

দিনদুপুরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১

১০

সাবেক ডিআইজি মোল্যা নজরুলের ফ্ল্যাট-জমি জব্দ

১১

সাবেক প্রতিমন্ত্রী চুমকির ফ্ল্যাটসহ ২ কোটি টাকা অবরুদ্ধ

১২

বাসস এমডিসহ তিনজনের নামে যুগান্তর সম্পাদকের মানহানি মামলা

১৩

বিএনপি নেতার ওপর অতর্কিত হামলা

১৪

প্রাইভেট-পাবলিক নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান হলো মূল বিষয় : ইউজিসি চেয়ারম্যান

১৫

চট্টগ্রাম মহানগরী মহিলা জামায়াতের মানববন্ধন

১৬

ওদের জন্য ইফতার, একসঙ্গে ইফতার- পজিটিভ মাইন্ডসেটের মানবিক উদ্যোগ 

১৭

ক্রিকেটার নাসির ও তামিমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য পেছাল

১৮

তরুণীকে নির্যাতন করায় লেডিবাইকার এশা গ্রেপ্তার

১৯

অবশেষে সুশান্তের মৃত্যু তদন্তের ইতি

২০
X