কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার নুনাছড়ি ফকিরাঘোনা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম আবু বকর ছিদ্দিক। মাসে ৩০ দিন পাঁচ ওয়াক্ত আজান ও নামাজ পড়িয়ে তিনি বেতন পান মাত্র ৩ হাজার টাকা। তার সংসারে ৫ ছেলেমেয়ে, বাবা আর স্ত্রী আছেন। তিনি জানান, মাস শেষে ৩ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলে না। পাশের একটি নুরানি মাদ্রাসায় পড়িয়ে সামান্য কিছু টাকা পান। দুটি মিলিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে চলতে হচ্ছে।
একই অবস্থা খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার দমদম বায়তুল মামুর শাহি জামে মসজিদের ইমাম মো. আবু তাহেরের। মাস শেষে চাঁদা তুলে তাকে দেওয়া হয় ৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘পরিবারে বাবা-মাসহ সদস্য সংখ্যা ৬ জন। বেতনের টাকা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে যায়। এই পেশায় কোনো ছুটি নেই। ঝড়বৃষ্টি কিংবা কনকনে শীত, যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকেও দিনে পাঁচবার নামাজ পড়াতে হয়’।
চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন উপজেলার অন্তত অর্ধশত ইমাম ও মোয়াজ্জিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলে মাস শেষে মসজিদ কমিটি থেকে ইমাম ৩ হাজার থেকে ৯ হাজার আর মোয়াজ্জিন ২ থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা বেতন পান। শহরাঞ্চলে দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া ইমামরা সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। এ টাকায় তাদের কোনোমতে টেনেটুনে চলতে হচ্ছে।
সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু পরিবর্তন হলেও শুধু বদলাচ্ছে না দেশের ইমাম-মোয়াজ্জিনের ভাগ্য। বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য যেভাবে হুহু করে বাড়ছে এবং সেই চাহিদা বিবেচনায় সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন-ভাতায় সামঞ্জস্যতা-ভারসাম্যতা রক্ষা করা হলেও কেবল মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনরা অবহেলায় থাকছেন যুগ যুগ ধরে।
তারা জানান, মসজিদে ইমামতির পাশাপাশি অনেকে ভিন্নভাবে আয়ের চেষ্টা করেন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাড়তি আয়ের সুযোগ কম তাদের। এর পরও অনেকে শিক্ষকতা, টিউশনি, ছোটখাটো ব্যবসা, কৃষিকাজ করে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করছেন। যদিও এ ক্ষেত্রে তারা নানাভাবে বাধার সম্মুখীন ও সমাজের কটূক্তি শুনতে হয়। সেইসঙ্গে মসজিদ কমিটির সদস্যদের কথায় কথায় বকাঝকা তো আছেই।
সব মিলিয়ে আর্থিক ও মানসিক অসহায়ত্বের কারণে ধর্মের এই গুরু দায়িত্ব পালনে পূর্ণ একাগ্রতা দিতে পারেন না অনেক মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনরা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ইসলামিক ফাউন্ডেশন কার্যালয়ে গিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের মসজিদের সংখ্যা ও ইমাম-মোয়াজ্জিনের সংখ্যা কত, সে তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি চট্টগ্রাম জেলা বা মহানগরীর তথ্যও দিতে পারেননি কর্মকর্তারা। তবে কার্যালয়ের একজন সাবেক পরিচালক চট্টগ্রাম বিভাগে মসজিদের সংখ্যা ৩০ হাজার হতে পারে বলে জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ ও জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনের বেতন রাজস্ব খাতভুক্ত। এ ছাড়া উপজেলা পর্যায়ে মডেল মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনের বেতন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়।
কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা মডেল মসজিদে একজন ইমাম, একজন মোয়াজ্জিন ও একজন খাদেম কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে ইমামকে ১৫ হাজার, মোয়াজ্জিনকে ১০ হাজার ও খাদেমকে বেতন দেওয়া হয় সাড়ে ৭ হাজার টাকা। অথচ এই মসজিদে গড়ে বিদ্যুৎ বিলই আসে ৪০ হাজার টাকা। বিভাগের অন্যান্য মডেল মসজিদের বিদ্যুৎ বিলও প্রায় এ রকমই আসে। কোনো কোনো মসজিদে বিদ্যুৎ বিল মাসে ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্তও আসে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইমাম কালবেলাকে বলেন, মসজিদের সাজসজ্জায় কর্তৃপক্ষের যে পরিমাণ মনোযোগ, তার সিকিভাগও যদি আমাদের বেতনের দিকে থাকত, তাহলে আমরা ভালো মানের একটা বেতন পেতাম। কমিটি শুধু মসজিদের উন্নয়নে কাজ করে, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা কম। বিদ্যুৎ বিল আমাদের বেতনের দ্বিগুণও আসে।
জানা যায়, প্রায় মসজিদেই কমিটির সদস্যরা ইমাম-মোয়াজ্জিনদের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদী আচরণ করেন। মসজিদ কমিটিতে শিক্ষার চেয়ে পয়সাওয়ালা লোকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে কমিটির লোকজন যখন তখন ইমাম-মোয়াজ্জিনদের চাকরিচ্যুতির হুমকি দেন। কোনো নীতিমালা না থাকায় কথায় কথায় চাকরিচ্যুতও করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুফতি হুমায়ুন কবির কালবেলাকে বলেন, ইমাম-মোয়াজ্জিনদের যে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, তা সত্যিকার অর্থেই অপ্রতুল। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে এই বেতনে চলা সম্ভব না। সরকারের উচিত সব মসজিদের জন্য একটি বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দেওয়া।
এ ক্ষেত্রে ইমাম-খতিবদের বেতন হতে পারে কমপক্ষে নবম গ্রেড সমপর্যায়ের আর মোয়াজ্জিন-খাদেমদের দশম গ্রেড সমপর্যায়ের। নিয়োগ ও চাকরিচ্যুতির জন্যও নীতিমালা থাকা উচিত। মসজিদ কমিটিতে যারা থাকবেন, তাদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে হবে। কমিটিতে নিয়মিত নামাজি লোক রাখার পাশাপাশি অন্তত একজন আলেম রাখতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা আমরা নতুনভাবে তৈরি করছি। একটা বিশেষজ্ঞ দল এটা নিয়ে কাজ করছে। কাজ প্রায় শেষের দিকে। নীতিমালায় ইমাম নিয়োগ, ইমাম বরখাস্ত, ইমামের বাসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির বিষয় থাকবে। সেখানে আমরা একটা বেতন কাঠামোও দেব। যেসব মসজিদ সরাসরি আমাদের আওতায় এবং স্বায়ত্তশাসিত ও ওয়াকফ প্রশাসনের আওতায়, সেগুলো এর আওতাভুক্ত হবে।
আর বেসরকারি সেসব মসজিদ আছে, সেগুলোর কমিটিকে আমরা জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে অনুরোধ করব, আর্থিক সচ্ছলতার সাপেক্ষে যেন ইমামদের বেতন, বোনাস ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, সেটা নির্দেশনা থাকবে।
তিনি বলেন, নীতিমালা চূড়ান্ত করার পর উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন হলে আমরা একটা ভার্চুয়াল কনফারেন্স করব। আমরা ইমাম-মোয়াজ্জিনদের জন্য একটা কিছু করে যেতে চাই।
মন্তব্য করুন