যশোরের কেশবপুরে বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা নিরসনে পানি উন্নয়ন বোর্ড আবারও ৩ নদী ও ১০ সংযোগ খাল পুনর্খননে ১৪৩ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৩টি নদীর পুনর্খনন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে করা হবে। কেশবপুরে এক সময়কার প্রবল খরস্রোতা হরিহর, কপোতাক্ষ ও বুড়িভদ্রা নদীতে নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ যাতায়াত ছিল। জমজমাট হাট বসত। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসত। সেই চিরচেনা নদনদীগুলোতে নেই কোনো স্রোত।
জানা গেছে, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলার বর্ষার অতিরিক্ত পানি হরি নদীর শাখা দেলুটি দিয়ে শিবশা নদী হয়ে সাগরে পতিত হয়। এসব নদীর সংযোগ খালে পাউবোর ৯১টি স্লুইচ গেট ও অসংখ্য পোল্ডার রয়েছে। খুকশিয়া ৮ ভেন্টে স্লুইচ গেটের সঙ্গে ছোটবড় ২৭টি বিল, নরনিয়া ৪ ভেন্টের সঙ্গে ১০-১২টি বিল, ভবদহের ২১ ও ৯ ভেন্টের সঙ্গে ছোটবড় ৫২টি বিল ও কোনো কোনো রেগুলেটরের সঙ্গে একাধিক বিল যুক্ত আছে, যা পোল্ডারে আবদ্ধ থাকায় দুপাশ পলিতে ভরাট হয়ে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না।
পোল্ডারের কারণে প্লাবণভূমির সঙ্গে নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বর্তমানে হরি নদীতে জোয়ার ওঠে না। ফলে নদীগুলো বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়ে বন্যায় রূপ নিয়েছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন বিলের মধ্যে ৫৯টি সরকারি খাল মৎস্য ঘের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উদ্ধার করে খনন করতে হবে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর হরি নদীর খর্নিয়া ব্রিজ থেকে ভবদহ ২১ ভেন্ট স্লুইচ গেট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার, হরি নদীর শাখা আপারভদ্রার কাশিমপুর থেকে মঙ্গলকোট ব্রিজ পর্যন্ত ১৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, বড়েঙ্গার তিন নদীর মোহনায় জিরো পয়েন্ট থেকে কেশবপুর মনিরামপুর হয়ে রাজগঞ্জ রোড পর্যন্ত হরিহর নদীর ৩৫ কিলোমিটার খননে ১৩১ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ছাড়া নদীর ১০টি সংযোগ খালের মধ্যে নুরানিয়া ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার, বাদুড়িয়া ৩ কিলোমিটার, শাখা নদী বুড়িভদ্রার ৫ কিলোমিটার, গরালিয়া ১ দশমিক ৩৫০ কিলোমিটার, কন্দর্পপুর ১ কিলোমিটার, কাশিমপুর ১ কিলোমিটার, ভায়না ১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, বিল খুকশিয়া ৭ দশমিক ৫০ কিলোমিটার, বুড়লি ৩ কিলোমিটার ও পাথরা ১ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পুনর্খননে ১২ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
তিন নদী মোহনার বাসিন্দা বড়েঙ্গা গ্রামের সুকুমার বিশ্বাস বলেন, প্রতি শুষ্ক মৌসুমের ১৫ মাঘ থেকে নদীতে পলি আসা শুরু হয়। এ জন্য ১৫ মাঘের আগেই আপারভদ্রার কাশিমপুরে সাময়িক ক্রসবাঁধ দেওয়ার দাবি জানানো হয়; কিন্তু বিলম্বে বাঁধ দেওয়া হয়। ফলে পলিতে নদী ভরাট হয়ে যায়। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় হরি নদীর বিল কপালিয়ায় টিআরএম বাস্তবায়ন ছাড়া সব পরিকল্পনায় অকার্যকর হবে। যে কারণে ২০১৯ সালে পাউবো নদী খননের নামে ভবদহ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করে; কিন্তু ২ বছর যেতে না যেতেই আবারও তা পলিতে ভরাট হয়ে ভয়াবহ বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
নদীতে মাছ শিকার করতে আসা নাজিমুদ্দিন বলেন, আগে হরিহর নদীতে বসে বড়শী দিয়ে মাছ ধরা যেত। এখন ময়লা আবর্জনা ও শ্যাওলা থাকায় সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে হরি-ঘ্যাংরাইল অববাহিকার জলাবদ্ধতা নিরসন কমিটির সভাপতি মহিরউদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ১৯৬০ সালের আগে এই অববাহিকায় গোনে-বেগোনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি ঘনমিটার পানি সঞ্চালিত হতো। পোল্ডার ব্যবস্থার পরে তা কমে ২ থেকে আড়াই কোটি ঘনমিটারে দাঁড়ায়। পলির পরিমাণ ঠিক থাকলেও পানির সঞ্চালন কমে যাওয়ায় জোয়ারের প্রান্ত ভাগ থেকে পলি জমতে থাকে। একই সঙ্গে ভূমির নিম্নগমন ও আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে জোয়ারের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অঞ্চলে ১৯৮৪ সালের পর থেকে পাউবো ডজন খানেক নানাবিধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও একমাত্র টিআরএম প্রকল্প ছাড়া, আর কোনো প্রকল্পই নদীর নাব্য সৃষ্টি বা ধরে রাখতে পারেনি। নদীর বুকে পলি জমা ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কেশবপুরের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সুমন সিকদার বলেন, বন্যা ও জলাবদ্ধতা নিরসনে ৩টি নদী ও ১০টি খাল পুনর্খননে সরকার ১৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে ৩টি নদীর পুনর্খনন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে করা হবে।
মন্তব্য করুন