কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

মুরাদনগরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী যুবলীগ নেতা আনোয়ারের আগমন ঘিরে হট্টগোল, সংঘর্ষ

মুরাদনগরের ম্যাপ। গ্রাফিক্স : কালবেলা
মুরাদনগরের ম্যাপ। গ্রাফিক্স : কালবেলা

কুমিল্লার মুরাদনগরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী যুবলীগ নেতা আনোয়ারের (ডাকাত) আগমন ঘিরে হট্টগোল ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির ব্যানার সজ্জিত ১০টি প্রাইভেট গাড়ির প্রটোকল দিয়ে রোববার (১৬ মার্চ) বাড়িতে পৌছে দেওয়া এবং স্থানীয়দের বাধার মুখে দোকানপাট, ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

জানা যায়, কুমিল্লার মুরাদনগরের শ্রীকাইল ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড উত্তর পেন্নাইগ্রামের মনু মিয়ার ছেলে আনোয়ার (যিনি ডাকাত হিসেবে পরিচিত)। তিনি ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কেন্দ্র দখল করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হন তিনি।

অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থী হত্যা মামলার আসামি মুরাদনগরের সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ঘনিষ্ঠতার প্রভাব দেখিয়ে গ্রামের মানুষকে জিম্মি করে রাখতেন আনোয়ার। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে মাদক ব্যবসা, নদী দখল, ড্রেজার, চাঁদাবাজি এমনকি নারীদের যৌন হয়রানিও করতেন তিনি। ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি এবং স্থানীয় ইউপি মেম্বার হওয়ায় তার কাছে জিম্মি ছিল ২নং ওয়ার্ডের মানুষ। তাকে চাঁদা না দিলে কারও ঘর নির্মাণ হতো না। দোকান করতে হলেও তাকে চাঁদা দিতে হতো।

চব্বিশের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে রাজু মিয়া নামে এক শিক্ষার্থীর পরিবারকে হুমকি এবং তার বাবার দোকান জ্বালিয়ে দেয় এই আনোয়ার ডাকাত।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর এলাকা থেকে পালিয়ে যান যুবলীগ সভাপতি আনোয়ার। গ্রামবাসী বসে সিদ্ধান্ত নেন আনোয়ার যাদের থেকে চাঁদা নিয়েছে সে টাকা উদ্ধার করবেন। গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে তালিকা করে দেখেন সব মিলিয়ে ১০ কোটি টাকা চাঁদা নিয়েছে আনোয়ার। সর্বজনের সিদ্ধান্ত হয় আনোয়ারকে এলাকায় আসতে হলে সবার টাকা ফেরত দিতে হবে।

এরইমাঝে আনোয়ারকে এলাকায় আসার সুযোগ করে দিতে বিভিন্ন জনকে মুঠোফোনে নির্দেশ দেয় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ঘনিষ্ঠ সহচর গোলাম কিবরিয়া। তবে এলাকাবাসী কোনোভাবেই চাঁদাবাজ যুবলীগ সভাপতি আনোয়ারকে এলাকায় প্রবেশ করতে দেবে না।

এরপরও গতকাল রোববার দুপুরে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির ব্যানারে সজ্জিত ১০টি প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে উত্তর পেন্নাই বাজারে বিভিন্ন দোকানপাট ভাঙচুর করে আনোয়ার (ডাকাত) এবং তার সঙ্গে আসা সন্ত্রাসীরা। ককটেল বিস্ফোরণ এবং ঘরবাড়িতে হামলা করে গ্রামে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তারা।

খবর পেয়ে গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। এর মাঝে ৩ জন দৌড়ে পালাতে না পেরে জনতার হাতে আটক হয়। আটকরা স্বীকার করে যুবলীগ সভাপতি আনোয়ার তাদের ভাড়া করে এনেছে।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গ্রামবাসী বাঙ্গরা থানায় মুঠোফোনে জানায়। পুলিশ এসে আটকদের ছেড়ে দিতে বললে জনতা তাদের ছেড়ে দেয়। তবে যুবলীগ নেতার ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের আটক না করায় প্রশাসনের ব্যাপারে জনতার সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে ২নং ওয়ার্ড উত্তর পেন্নাইয়ের ৫ বারের সাবেক মেম্বার ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘মনু চোরার পোলা আনোয়ার আওয়ামী লীগের লোক। সে বিভিন্ন জনের থেকে এমনকি তার সাঙ্গপাঙ্গরাও ২০ লাখ, ৩০ লাখ টাকা কইরা প্রতিডা মানুষ থেইকা নিছে। আমি মুরুব্বি মানুষ আমার লগেও যে আচরণডা করছে ভুলতারতাম না। তার জ্বালায় মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। চরিত্রের ঠিক নাই, এহন বেয়াইন লইয়া ঘুরে! বিয়া করছেনি কে জানে।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী রাজু মিয়া বলেন, আমরা যখন আন্দোলন করছি তখন এই যুবলীগ সভাপতি আনোয়ার আমাদের বিভিন্ন মোড়ে অ্যাটাক করছে। আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যাওয়ায় তার ভাইয়েরা আমার বাবার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে না পারায় আমাদের দোকান তালা দিয়ে দেয়। আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করলাম এখন দেখি এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া লোকদের নতুন দলের নেতৃত্বে আনোয়ার মেম্বারকে এলাকায় নিয়ে আসে? এটা কিভাবে সম্ভব?

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের স্থানীয় আরেক শিক্ষার্থী তামজিদ মিয়া বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমি ফরদাবাদ, ওয়াই ব্রিজ স্পটে ব্লক করা থেকে শুরু করে লোকসমাগমে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছি। আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার সরাতে পেরেছি কিন্তু স্বৈরাচারের দোসরদের সরাতে পারিনি। আমাদের গ্রামের ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি আনোয়ার ডাকাত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বাধা দিয়েছে এবং বিভিন্ন মোড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে। সে কিভাবে জাতীয় নাগরিক পার্টির ব্যানারে ১০টি গাড়ি নিয়ে গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে? সরকারের কাছে আনোয়ারের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।

উত্তর পেন্নাই গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের রাতের ভোটের এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের গুন্ডা আনোয়ার ডাকাত কিভাবে এলাকায় ঢুকে এলাকাবাসীর ওপর হামলা চালায়? প্রশাসনের কাছে জানতে চাই? ওরা এত সাহস কিভাবে পায়?

একই গ্রামের প্রবাসী মনির প্রধান বলেন, আমি একজন প্রবাসী। শুধু বিএনপি করার অপরাধে আমার ওপর আনোয়ার ডাকাত অতর্কিত হামলা চালায়। আমার মাথায় জখম করে এবং হাত ভেঙে দেয়। আমি হাসপাতাল থেকে ফিরে মামলা করি। তখন সে সিনেমা স্টাইলে আমার বাবা-মায়ের গলায় ছুরি ধরে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করে।

কবির মুন্সি নামে একজন জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে আনোয়ার ডাকাত গ্রামের মানুষকে নির্মম নির্যাতন করত। আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা নিছে। ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর সে নিজেই পালিয়ে যায়। আজ আবার ১০টি গাড়ি এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে।

শাহাবুদ্দিন নামে এক অটোরিকশা চালক বলেন, আমি অটো চালাইয়া আসতেছি আনোয়ার ডাকাত দেখে তার দলবল নিয়ে আমার ওপর হামলা করে। পরে চিৎকার শুনে এলাকাবাসী এসে আমাকে উদ্ধার করে।

উত্তর পেন্নাই গ্রামের ফারুক ভুইয়া বলেন, যুবলীগ নেতা আনোয়ার ডাকাত ৫ তারিখ পালিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার সে কাদের প্রশ্রয়ে এলাকায় ঢুকে মানুষের ওপর হামলা করে ঘরবাড়ি, দোকান ভাঙচুরের সুযোগ পেল? ফ্যাসিস্ট আনোয়ারের বিচার চাই।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, যুবলীগ সভাপতি আনোয়ার ক্ষমতার দাপটে অনেক মানুষ থেকে চাঁদা নিয়েছে। মানুষকে নানা অজুহাতে নির্যাতন করেছে। যুবলীগের এ সন্ত্রাসীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার জোর দাবি জানান তিনি।

যুবলীগ সভাপতি আনোয়ারের সন্ত্রাসী হামলায় আহত হন অনেকেই। বসতঘর এবং দোকানেও ভাঙচুর করে। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিতে গেলে বাঙ্গরা থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মাহফুজুর রহমানকে তাৎক্ষণিক মুঠোফোনে কল দিলে তিনি বলেন, ‘আপনি অ্যারেস্ট হন কি না তাই দেখেন! অভিযোগ পরে করেন। কল রাখেন।’ (পরে বিষয়টি ঠিক নয় বলে জানান ওসি)।

এরপর সোমবার (১৭ মার্চ) ওসিকে ফোন করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কালবেলাকে বলেন, ৯৯৯-এ হামলার ঘটনা সম্পর্কে কল পেয়ে তিনি ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে যান। পরে গিয়ে দেখেন আনোয়ার ও আলমগীর মেম্বারের অনুসারীদের মাঝে সংঘর্ষ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, আনোয়ার মেম্বার এলাকায় আসার খবরে ঘটনার সূত্রপাত। এ সময় কয়েকজন আহত হয়েছেন এবং আনোয়ার মেম্বারের ঘরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আমরা স্থানীয়দের নিয়ে আগুন নেভাতে সক্ষম হই। এ সময় স্থানীয়রা তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে বললে দেখি যে তাদের মারধর করায় আহত হয়েছে। ফলে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলি আগে। ঘটনাস্থল থেকে কাউকে আটক করা হয়নি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ১৯ নেতাকর্মীকে শাস্তি

নরসিংদীতে তিন সন্তানের জননীকে ধর্ষণের অভিযোগ

জুলাই-আগস্টে ঢাবিতে ছাত্রলীগের হামলা, ১২৮ জন সাময়িক বহিষ্কার 

যুবদলের জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে সড়ক কেটে দেয়াল নির্মাণের অভিযোগ

নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানববন্ধন

ভুল চিকিৎসায় তরুণের মৃত্যু, ৪ লাখ টাকায় দফারফা

মাদ্রাসাছাত্রকে চাপা দিয়ে পালানোর সময় ট্রাকচালক গ্রেপ্তার

বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে মার্কিন গোয়েন্দা প্রধানের সাক্ষাৎকার

সাবেক এমপি মঞ্জুসহ বিএনপির ৬৩ নেতাকর্মী খালাস

ফিরছেন মহাকাশে আটকে পড়া দুই নভোচারী

১০

বাংলালিংকের নতুন সিইও হচ্ছেন ইওহান বুসে

১১

নিয়োগে সুপারিশ, নাহিদ ও নুসরাতকে নিয়ে মুখ খুললেন মাসুদ

১২

সেই মন্টু দাসের পরিবারের দায়িত্ব নিল জামায়াত 

১৩

জেলেদের চাল বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ

১৪

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি ফেরত চাইলেন ফরাসি এমপি

১৫

রাজশাহীতে মাদকবিরোধী অভিযানে ছুরিকাঘাতে পুলিশ সদস্যসহ আহত ২

১৬

‘ঘুষের রেট নির্ধারণ’ নিয়ে সভা / শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদককে শোকজ

১৭

আইনজীবী আলিফ হত্যা, দুই আসামিকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি

১৮

লোহিত সাগরে মার্কিন রণতরীতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

১৯

ছোট বড় বিষয় নয়, ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই সংস্কার : স্বপন 

২০
X