সিলেটের সুরমার চির যৌবন দেখতে একটা সময়ে ছুটে আসত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। সবুজেঘেরা সুরমার মায়াবী ঘাটে বসে স্বজনদের নিয়ে বসত গল্প, আড্ডা ও গানের আসর। নদীপ্রেমী মানুষরা সেখানে বসে সময় পার করতেন। আর স্থানীয়রা সুরমায় নিত্যদিন সাংসারিক প্রয়োজনীয়তাসহ বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতেন।
দিনের পরদিন, বছরের পর বছর তারা সেখানেই জীবনযাপন করত বড়শি দিয়ে ছোট-বড় মাছ মেরে। আজ সেই চিরচেনা সুরমার যৌবন একেবারে বিলুপ্ত বলা যায়। সেকালের সুরমার যে রূপ-লাবণ্য ছিল, সে যৌবন আজ ময়লা-আবর্জনার স্তূপে প্রায় মৃত।
সরেজমিনে দেখা যায়, সংকটের মুখে সুরমা নদী দেখতে গিয়ে চোখে পড়ে নদীর একপাশে জমে ঠিক সুরমার মধ্যখানে চলে এসেছে দুর্গন্ধ ভরা ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সিলেট নগরীর বুক চিরে বয়ে যাওয়া চিরচেনা সুরমা এখন বিলুপ্তের পথে হাহাকার করছে।
দূর থেকে কেউ বুঝতেই পারবে না যে, এখানে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। অন্য স্থানে নদীর ঠিক মধ্যখান পর্যন্ত ময়লার স্তূপ জমে রয়েছে। দেখে মনে হয়, ময়লার ভাগাড়। নদীরানি সুরমার আজ হৃতযৌবন, খরস্রোতা সুরমা আজ মৃত প্রায়।
নদীর পাড়ে অন্তত ৫০টি স্থানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমেছে। আবর্জনা ফেলায় সারাক্ষণ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এ ছাড়া সিলেট বিভাগের নদীর পাড় দখল করে ৪৪১ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
জানা যায়, কাজিরবাজার, কুশিঘাট, মাছিমপুর, কালিঘাট, তোপখানা, চাঁদনীঘাট ও কদমতলী এলাকায় এ চিত্র। জায়গাগুলোতে পচা ও উচ্ছিষ্ট খাবার, কলার কাঁদি, নারকেল ও সুপারির বাকল, ক্লিনিক্যাল বর্জ্য, পরিত্যক্ত বস্তা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের খালি প্যাকেটসহ বাসাবাড়ি ও হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্যে ভরে আছে। পাড় থেকে সেই ময়লা নদীতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে, মশা-মাছি উড়ছে। নদীতীরের বাসিন্দারা দুর্ভোগে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবসে সিলেট বিভাগের নদ-নদীকে দখল দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে ও নদী ধ্বংসের অপকর্ম বন্ধ করতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পরিবেশবাদীরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের চার জেলায় প্রায় ১৩৪টি নদীর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে শুষ্ক মৌসুমে ১০০টি নদী চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে যায়। তারপরও ইউনিয়ন থেকে ইউনিয়নে, উপজেলা থেকে উপজেলায় এই নদীর নাম পাওয়া যায়, চিহ্ন দেখা যায়। সুরমা, কুশিয়ারা, খোয়াই, মনু, যাদুকাটা, ধলা, ধলাই, জুড়ি, বাসিয়া, বোকা, মাগুরা, সোনাই, সুতাং, নলজুড়সহ সিলেটের বিভিন্ন নদী এখন দূষণে বিপর্যস্ত। তীরের প্রায় প্রতিটি গঞ্জ-বাজারের আবর্জনার শেষ গন্তব্য হয় নদী। এই আবর্জনায় প্লাস্টিক বর্জ্যই বেশি।
সিলেট মহানগরীর ভেতর দিয়ে প্রবহমান আছে ২৬টি ছড়া বা খাল। ছড়া বা খালগুলো গিয়ে মেশে সুরমা নদীতে। এই ২৬টি ছড়া বা খালে প্রতিদিন ন্যূনতম ৫০ টন নাগরিক বর্জ্য ফেলা হয়। যা সুরমা নদীকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। নাগরিক বর্জ্যে নদীর তলদেশ ভরাট হয়। এতে জলজ প্রাণের ক্ষতি হয় বলে জানান পরিবেশবিদরা।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় সুরমা নদীর ৪৫০ মিটার জায়গা ১৫০ জন দখলদারের কবলে। তারা নদীতীরবর্তী স্থানে ১০০টি স্থাপনা গড়ে তুলেছেন। এ ছাড়া সিলেট বিভাগের নদীর পাড় দখল করে ৪৪১ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দখল-দূষণের পাশাপাশি সিলেটের নদ-নদীগুলো সংকটাপন্ন হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে ভারতের পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলিমাটিতে নদীর উৎসমুখ ভরাট হওয়া। এছাড়া মানুষের অসচেতনতা ও লোভের কারণে বর্তমানে অস্তিত্ব সংকটে সিলেটের নদ-নদীগুলো।
বেলা সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, বাড়িঘর তৈরিসহ বহুমুখী কাজে ভরাট করা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বাণিজ্যিক উদ্দেশে দখল, ময়লা আবর্জনা ফেলে দূষণ ও ভরাট, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার বর্জ্যের মাধ্যমে দূষণ ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের নদ-নদী। বাড়িঘর তৈরিসহ বহুমুখী কাজে ভরাট করা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বাণিজ্যিক উদ্দেশে দখল, ময়লা আবর্জনা ফেলে দূষণ ও ভরাট, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার বর্জ্য দ্বারা দূষণ ও কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের নদ-নদী। সিলেট বিভাগের ৩১টি বেশি সংকটাপন্ন নদীর মধ্যে সিলেট জেলার আছে ৯টি নদী, সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি নদী, মৌলভীবাজার জেলার ৫টি নদী ও হবিগঞ্জ জেলার ৬টি নদী।
বেলা আরো জানায়, সিলেট বিভাগের ১৭টি নদ-নদী দখল করেছেন ১১৯৪ জন। এর মধ্যে সুরমা নদী সিলেট অংশে দখল করেছেন ১৫১ জন ও সুনামগঞ্জ অংশে দখল করেছেন ৩২ জন। কুশিয়ারা নদী সিলেটে ২০০ জন, মৌলভীবাজারে ১২৫ জন ও হবিগঞ্জে ৯ জন। হবিগঞ্জ জেলার খোয়াই নদী ১৩৫ জন, বিবিয়ানা নদী ৩৫ জন, ডেবনা নদী ১৯ জন ও কাষ্টি নদী ৬ জন দখল করেছেন। সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী ৪৪ জন। লাউয়া নদী ৩২ জন। নলজুর নদী ৪৯ জন। রত্না নদী ৩৭ জন। টগী নদী ১৪ জন, কুশিউড়া নদী ৭০ জন। রক্তি নদী ২৪ জন। বৌলাই নদী ১৭ জন। মরাচেলা নদী ৪৪ জন দখল করেছেন। সিলেটের বাসিয়া নদী ১৮৬ জন ও সারি নদী ১১৭ জন দখল করেছেন।
সিলেটের সংকটাপন্ন নদীগুলো হচ্ছে, সুরমা, কুশিয়ারা, ডাউকি, পিয়াইন, ধলাই, লোভা, সারি, বাসিয়া, চেঙ্গের খাল। সুনামগঞ্জ জেলার সংকটাপন্ন নদীগুলো হলো- ধোপাজান, যাদুকাটা, নলজুর, বৌলাই, রক্তি, চেলা, খাশিয়ামারা, কুশিউড়া, মাহরাম, মহাসিং, বোকানদী। মৌলভীবাজার জেলার সংকটাপন্ন নদীগুলো হলো, ধলাই, মনু, জুড়ী, কণ্ঠীনালা, গোপলা নদী। হবিগঞ্জ জেলার সংকটাপন্ন নদীগুলো হলো- খোয়াই, সুতাং, সোনাই, বরাক, কাষ্টি, করাঙ্গী।
নদীতে মাছ শিকার করা রফিক আহমদ কালবেলাকে বলেন, আগে সুরমা নদীতে বসে বরশি দিয়ে মাছ শিকার করতাম। ময়লা-আবর্জনার স্তূপের কারণে এখন সুরমা প্রায় মৃত। দুর্গন্ধের কারণে মাছ শিকার করা যায় না আর। নদী খননের জন্য প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানান তিনি।
কাজীর বাজারের বাসিন্দা লতিফ মিয়া বলেন, তুফখানা ও কাজীরবাজারের কিছু জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দারা আবর্জনা ফেলার পাশাপাশি নিয়মিত প্রস্রাব-পায়খানা করে। পুরো নদীর পার এলাকা দুর্গন্ধে মানুষ চলাফেরা করতে পারছে না। এ ছাড়া সুরমা নদীর পাড়ে বিভিন্ন স্থানে আবর্জনা ফেলে রাখায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক সাংবাদিক ছামির মাহমুদ বলেন, সুরমা নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। নদীর শহর অংশে হাজার হাজার টন পলিথিন বর্জ্য ইতোমধ্যে নদীর তলদেশে রয়েছে, যেগুলো অপচনশীল। নদীতে কয়েক স্তরে পলিথিন জমেছে। এতে নদীর কোথাও কোথাও ৫-৬ ফুট পর্যন্ত নদীর তলদেশ পলিথিনে ঢাকা রয়েছে।
তিনি বলেন, সুরমা নদীকে যেন বর্জ্য ফেলার ভাগাড় মনে করা হচ্ছে। এ কারণে নদীর তলদেশে এতো পলিথিন। যার কারণে নদীর পানি এখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অথচ এই পানি শোধন করে সুপেয় পানি হিসেবে নগরে সরবরাহ করছে সিলেট সিটি করপোরেশন। সুরমা নদীতে ময়লা আবর্জনা ফেলা এখনই বন্ধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে সুরমা মরা খালে পরিণত হবে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ কালবেলাকে বলেন, আমরা নদী খননের জন্য একটি প্রকল্প ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এই প্রকল্প পাস হয়ে গেলে নদী খনন করা হবে। আগের প্রকল্পের মেয়াদ জুন মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত ছিল। সেটির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।
নদী দখল বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নদী দখল এবং দূষণ নিয়ে বিভাগীয় কমিশনার অফিস সারা বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তারা ডাটা কালেকশন করছে। আর আবর্জনার বিষয়টি ডিলেট সিটি করপোরেশন বুঝবে। আর সবচেয়ে বড় জিনিস হচ্ছে আমরা নিজেরা সচেতন না। সবার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) মো. একলিম আবেদীন কালবেলাকে বলেন, নদী খননের বিষয় আসলে পানি উন্নয়নের কাজ। আর নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের যাতে মানুষে ময়লা আবর্জনা না ফেলতে পারে সেজন্য কিছুদিন আগে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়ে। বর্ষার আগে আরেকবার করব। আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে এটা আসলে অভিযান দিয়ে কন্ট্রোল করা বা রোধ করা যাবে না। আর নদী ড্রেজিংয়ের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ড দেখবে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহমুদ মুরাদ কালবেলাকে বলেন, নদী খনন প্রক্রিয়া চলমান কাজ। এটা পানি উন্নয়ন বোর্ড করছে। দখলের যে বিষয়টি রয়েছে সেটি আমরা হালনাগাদ করছি। সুরমা এবং কুশিয়ারা নদী বড় আকারের খনন করার জন্য যাতে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ে সে জন্য তারা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সে প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের আছে। এটা পাস হয়ে এলে একটা বড় আকারের পরিবর্তন আসবে।
ময়লার বিষয়ে তিনি বলেন, ড্রেনগুলো পরিষ্কার করলে আশা করি নদীর আবর্জনা থাকবে না। সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলে ড্রেনগুলো পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেব।
মন্তব্য করুন