বগুড়ায় অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের দায়ে যুবলীগের সাবেক নেতা আব্দুল মতিন সরকারকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও অবৈধভাবে অর্জিত ২ কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৩১৫ টাকা জরিমানা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) দুপুরে বগুড়ার স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক সিনিয়র জেলা জজ মো. শহীদুল্লাহ এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জরিমানা প্রদানে ব্যর্থ হলে আব্দুল মতিন সরকারকে আরও ৬ মাস কারাবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আব্দুল মতিন পলাতক রয়েছে। তার অনুপস্থিতিতেই প্রায় ৭ বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় এই রায় ঘোষণা করা হয়।
রায় প্রদানকালে বগুড়ার স্পেশাল জজ মো. শহীদুল্লাহ প্রকাশ্য আদালতে জানান, আসামি আব্দুল মতিন সরকারের পিসিআর (প্রিভিয়াস কেস রেকর্ড) খারাপ। অন্য একটি মামলায় তার ২০ বছরের সাজা হয়েছে। জনগণের কাছে তিনি মূর্তিমান আতঙ্ক। এসব কারণে রাষ্ট্রপক্ষের চাওয়া অনুযায়ী তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। ওই একই আদালত প্রায় ৪ মাস আগে গত ২৭ নভেম্বর আব্দুল মতিন সরকারের ছোট ভাই দেশজুড়ে আলোচিত ‘তুফানকাণ্ডের’ হোতা সাবেক শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারকেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে পৃথক দুটি ধারায় ১৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। বর্তমানে কারাগারে আটক তুফান সরকারকে দুটি ধারায় ১৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাড. আবুল কালাম আজাদ জানান, আব্দুল মতিন সরকারের বিরুদ্ধে মামলায় মোট ১৩ জন সাক্ষী ছিলেন।
তিনি জানান, সম্পদ বিবরণীতে তথ্য গোপন করায় আদালত দুদক আইনের ২৬(২) ধারায় আব্দুল মতিন সরকারকে ৩ বছরের কারাদণ্ড এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করায় ২৭(২) ধারায় ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ২ কোটি ২৮ লাখ ৩১ হাজার ৩১৫ টাকা জরিমানা করেন।
রায়ে বলা হয়, পৃথক দুটি ধারায় সাজা পৃথকভাবে চলবে অর্থাৎ আব্দুল মতিন সরকারকে ১৩ বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ার এক সময়ের যুবলীগ নেতা আব্দুল মতিন সরকার এবং তার ছোট ভাই শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকার তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে শাসক দলের কতিপয় নেতার ছত্রছায়ায় জেলাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল। মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজিই ছিল তাদের মূল পেশা। কেউ বাধা দিলেই তাকে হত্যা করতেও দ্বিধা করত না। দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলাও রয়েছে। এর আগে একটি অস্ত্র মামলায় আব্দুল মতিন সরকারের ২০ বছরের সাজা হয়। সেই সাজার বিরুদ্ধে আব্দুল মতিন সরকার উচ্চ আদালতে আপিল করেন।
তবে ভালো কলেজে ভর্তির প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই এক কিশোরীকে ধর্ষণ এবং তাকে ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে পুলিশ তুফানকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। সেই ‘তুফানকাণ্ডে’র পর আব্দুল মতিন সরকারও গা ঢাকা দিতে বাধ্য হয়েছিল। ওই ঘটনার পর শ্রমিক লীগের বগুড়া শহর কমিটির আহ্বায়কের পদ থেকে তুফান সরকারকে এবং শহর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আব্দুল মতিন সরকারকে বহিষ্কার করা হয়।
‘তুফানকাণ্ডের’ পর তুফান এবং মতিনের অবৈধ কারবার এবং তাদের বিত্ত-বৈভব নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দুদক নড়েচড়ে বসে। এরপর ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর দুদকের বগুড়া কার্যালয়ের কর্মকর্তারা তুফান সরকার ও আব্দুল মতিন সরকারের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। অনুসন্ধানে দুদক নিশ্চিত হয় যে, আব্দুল মতিন সরকার ১ কোটি ৪২ লাখ ১৯ হাজার ৪৯৩ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছে। আর অবৈধভাবে ২ কোটি ২৮ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছে। এরপর দুদক বগুড়া কার্যালয়ের তৎকালীন সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আব্দুল মতিন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দীর্ঘ প্রায় ১৪ মাস তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর আদালতে চার্জ গঠন করা হয়। তবে চার্জ গঠনের আগেই আদালত ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মতিন সরকারের অবৈধ সম্পদ ক্রোক এবং তার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব ফ্রিজ করার নির্দেশ দেন।
মন্তব্য করুন