শেরপুর জেলার তিনটি উপজেলায় বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে গারো পাহাড়। এ পাহাড়ের বনভূমিতে প্রায়ই আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা। গত বুধবার (৫ মার্চ) দুর্বৃত্তদের লাগানো আগুনে জ্বলছে ঝিনাইগাতীর কাংশা, রাংটিয়া, হালচাটি, গান্ধীগাঁও, গজনী বিট, দরবেশ টিলাসহ শালবনের কমপক্ষে ২০টি জায়গায়। বাতাসের তোড়ে আগুন প্রবল বেগে ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ে।
শনিবার (৮ মার্চ) সরেজমিনে দেখা গেছে, এবার সবচেয়ে বেশি বন পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া রেঞ্জ এলাকায়। এতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত সুফল বাগানের কোনো ছোট গাছ সেখানে আর নেই বললেই চলে। এ ছাড়া জঙ্গলে বসবাস করা ছোট প্রাণী ও বনজ গুল্মলতা আগুনে পুড়ে বনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্টসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। তবে বন বিভাগ বলছে, বনে আগুন লাগানো বন্ধে মাইকিং করে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, আগুনে শুধু বিভিন্ন গাছপালা ও প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে না। এর সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতিও। অভিযোগ উঠেছে, আগুন ধরানোর পেছনে বেশ কয়েকটি চক্র রয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ে আগুন দিয়ে রাতের অন্ধকারে বনের মূল্যবান গাছ চুরি করছে একটি চক্র। পাশাপাশি অসাধু বালু ও পাথর ব্যবসায়ীরা অসৎ উদ্দেশ্যে বনের ভেতর আগুন দিয়ে ভীতির সৃষ্টি করছে। তারা আরও জানান, বনের জমি দখল ও লাকড়ি সংগ্রহ করতে একদল দুর্বৃত্ত আগুন দিচ্ছে। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নতুন গজিয়ে ওঠা চারাগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও সবচেয়ে বড় অভিযোগের তীর হচ্ছে চোরাকারবারিদের দিকে। রাতে পাতার ওপর দিয়ে হাঁটলে শব্দ হয়। এ জন্য তাদের চলাচলের পথ পরিষ্কার করতেই দেওয়া হয় আগুন। এতে আগুনে বিনষ্ট হচ্ছে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী, কীটপতঙ্গ ও পাখি। এভাবে চলতে থাকলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
রাংটিয়া রেঞ্জের গজনী বিট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়ি সীমান্ত সড়কের দুপাশে বিভিন্ন স্থানে বিশাল এলাকাজুড়ে আগুনে পুড়ে ছোট গাছগুলো ছাই হয়ে আছে। মূলত গাছের পাতা ঝরে মাটির ওপর এক ফুট উঁচু হয়ে আছে। সেই পাতা প্রখর রোদে শুকিয়ে খরখরে হয়ে আছে। গভীর বনে পাতার পরিমাণ আরও বেশি। মূলত শুকনো এ পাতাতে অল্প পরিমাণ আগুনের সূত্রপাত হলেই ঘটে বিপত্তি।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহ বন বিভাগের আওতায় ঝিনাইগাতী উপজেলার রাংটিয়া রেঞ্জের আওতায় তিনটি বিট কার্যালয় রয়েছে। এ তিনটি বিট কার্যালয়ের আওতায় বনভূমি রয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৮৮০ একর। এর মধ্যে বেশিরভাগ জমিতে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। প্রতি বছর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছের পাতা ঝরে পড়ে। বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে চলাচলের জন্যে সড়কপথ থাকায় এ সময় খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা বনে আগুন দিয়ে সরে পড়ে। ঝরা পাতাগুলো শুকনো থাকার কারণে আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে।
ছোট গজনী এলাকার সামাজিক বনায়নের অংশীদার ও স্থানীয় কৃষক হুরমুজ আলী বলেন, বনে বেশি পরিমাণ পাতা জমা হয়েছে। যার জন্য বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকেও আগুন লেগে যাচ্ছে। বাইরে থেকে আসা পর্যটকরাও না বুঝে বিড়ির আগুন ফেলছে। আমরা আগুন নেভাতে বন বিভাগের লোকজনের সঙ্গে কাজ করছি।
রাংটিয়া এলাকার কৃষক হামিদুল্লাহ জানান, বনে আগুন লাগলে অল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তবে বন বিভাগের লোকজন এলাকার মানুষদের সচেতন করে না। গতকাল মাইকিং করা হলেও এবার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
ময়মনসিংহ থেকে আসা পর্যটক মাহাদি মাহমুদ বলেন, যেহেতু শুষ্কু মৌসুম চলছে, তাই এ সময় ক্ষতির হাত থেকে বনকে রক্ষা করতে বন বিভাগকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে নতুন গাছ বড় হতে পারবে না। বন ধ্বংস এবং বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়াও অতিসত্বর কঠোর নজরদারি বাড়িয়ে দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনা হোক।
পরিবেশবাদী সংগঠন শাইনের নির্বাহী পরিচালক মুগনিউর রহমান মনি বলেন, গারো পাহাড়ে আগুন দিয়ে গাছপালা ধ্বংসসহ প্রাণী ও কীটপতঙ্গ হত্যা করছে একদল দুর্বৃত্ত। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে আমাদের অনুরোধ, বন বাঁচাতে দ্রুত এসব দুর্বৃত্তকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।
ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এসবি তানভীর আহমেদ ইমন কালবেলাকে বলেন, এখন শুকনো মৌসুম, শালপাতা খুবই শুষ্ক অবস্থায় বনে পড়ে স্তূপ হয়ে থাকে। এখানে স্থানীয় বাসিন্দা ও গজনী অবকাশ এলাকায় টুরিস্টদের আনাগোনা বেশি। এ ছাড়া বনে গরুর রাখালের বিচরণ থাকায় তারা যে বিড়ি বা সিগারেট খায় সে আগুন থেকেই জঙ্গলে আগুনের সূত্রপাত বলে আমরা মনে করছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা এক জায়গার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না আনতেই শুনি আরেক জায়গায় আগুন জ্বলছে। আমরা আছি মহাবিপদে। কারণ, আমাদের জনবল খুবই কম। কম জনবল দিয়ে এত বড় পাহাড়ের আগুন নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন। তার পরও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
মন্তব্য করুন