জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল কয়রার মানুষের জীবনযাত্রা। নিয়ম করে বছরের বিভিন্ন সময় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে নদ-নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীর স্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। সে সঙ্গে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
এক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়নে জেন্ডার সমতার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে উপকূলের নারীদের সমতা দূরের কথা, এখনো স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করাই সম্ভব হয়নি। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে নারী স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
গত কয়েক দশকে উপকূলীয় এলাকায় পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিপন্নতার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দু-একটি নলকূপে- যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা না হলে কলসি নিয়ে পানির খোঁজে দীর্ঘপথ হাঁটতে হয় এসব নারীদের। আবার রান্নার জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করতে নারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয় কাঠ কুড়াতে।
উপকূলের নারীদের শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি প্রয়োজন, সেই পানি সংগ্রহ করার দায়িত্বও নারীর। তাই সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় নারীকে সামনে দাঁড়াতে হয়।
উপকূলীয় অঞ্চল খুলনার কয়রা উপজেলার নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়। এ ছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। সেখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়ি পোনা ধরার জন্য নদীর লবণাক্ত পানিতে প্রায় ৪-৫ ঘণ্টা তাদের থাকতে হয়। ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন এসব নারী ও শিশুরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তি তাপমাত্রা, বন্যা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে গর্ভবতী নারীরা নানা স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডেলিভারি সম্পর্কিত জটিলতা, অকাল প্রসবসহ বাচ্চার জন্মগত সমস্যা মোকাবিলা করছেন। লবণাক্ত পানির কারণে নারীরা এখন জরায়ু ক্যান্সারের মতো জটিল রোগে ভুগছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রতি বছর যে কয়েক লাখ নারী জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলের নারী। নারীদের জরায়ুসংক্রান্ত অসুখের তীব্রতা লবণাক্ততা প্রবণ গ্রামগুলোয় বেশি দেখা যায়। সে জন্য অল্প বয়সেই এ এলাকার নারীরা জরায়ু কেটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন।
শাকবাড়িয়া নদীর পাশে বসবাসকারী স্বামী পরিত্যক্তা বনজীবী নারী রেহানা খাতুন বলেন, উপকূলে জীবিকা নির্বাহের জন্য ৫০ শতাংশ নারীকে নদীতে মাছ ধরাসহ মৎস্য ঘেরে কাজ করতে হয়। আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে যাবার পর থেকে আমি নদীতে জাল টেনে ও মৎস্য ঘেরে কাজ করে দুই মেয়েকে নিয়ে কোনো রকম সংসার চালাই। লবণ পানিতে নামলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে অ্যালার্জি, ঘা-পাঁচড়া, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হতে হয়। অকাল গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটছে। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের অঞ্চলে জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনা অহরহ।
কয়রার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের বতুল বাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি উম্মেহানী আক্তার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের নারীর মধ্যে দেখা দেয় পুষ্টিহীনতা। প্রায় সময় নারীর মধ্যে অনিয়মিত ঋতুস্রাব, জরায়ুতে সিস্ট, অসময়ে মেনোপোজসহ প্রজনন স্বাস্থ্যের নানা জটিলতা। কমিউনিটি পর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা বাড়ানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে এ সমস্যা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, লবণাক্ততার ফলে চর্মরোগের পাশাপাশি ছত্রাকজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব অঞ্চলের নারীরা। লবণ পানির সংস্পর্শে থাকলে নারীদের জরায়ুসহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আমরা সাধ্যমতো সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী সংকটের পাশাপাশি এ অঞ্চলের নারীদের সচেতনতার অভাবে কিছুটা জটিলতা বাড়ছে।
মন্তব্য করুন