এক যুগ আগেও ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর চাড়োল গ্রামে বেশি চাষ হতো গম, ভুট্টা, আলু। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। এ অবস্থায় খানিকটা ঝুঁকি নিয়েই পেঁয়াজ বীজের আবাদ শুরু করেন হাতেগোনা কয়েকজন চাষি। এ থেকে মুনাফা হয় বেশ। এরপর থেকেই গ্রামটিতে বাড়ছে এর চাষ।
এবারও পেঁয়াজ বীজে স্বপ্ন বুনছেন চাষিরা। চলতি বছর চাড়োল গ্রামে পেঁয়াজ বীজ আবাদ হয়েছে ১২৫ হেক্টর জমিতে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। যারা দিনমজুরি করেন, তারাও জমি বন্ধক নিয়ে কমপক্ষে ১ বিঘা জমিতে এর আবাদ করেছেন।
চাড়োল গ্রামের চাষিদের দেখে পেয়াঁজ বীজ চাষে আগ্রহ বেড়েছে গোটা ঠাকুরগাঁওয়ে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চলতি মৌসুমে শুধু চাড়োল ইউনিয়নে ৩টি ব্লক- চাড়োল, সাবাজপুর ও দোগাছি ব্লকে ২৫০ হেক্টরে পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে। এসব ক্ষেতে উৎপাদিত বীজের বাজারমূল্য প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। আর পুরো উপজেলায় এর আবাদ হয়েছে ৫১০ হেক্টরে, যার বাজারমূল্য ১২০ কোটি টাকার মতো।
চাষিরা জানান, কিং, কুইন, তাহেরপুরী ও সুখসাগর পেঁয়াজের বীজ উৎপাদনে এই এলাকার মাটি উপযোগী। চলতি বছর এর আবাদে প্রতি বিঘায় লাগছে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। এবার বিঘায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০-৩০ হাজার টাকা। গত বছর প্রতি কেজি বীজ বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৭০০ টাকায়। এবার প্রতি কেজি কমপক্ষে ২ হাজার টাকায় বিক্রির প্রত্যাশা করছেন চাষিরা।
বালিয়াডাঙ্গীর চাড়োল, ধুকুরঝাড়ী, সাবাজপুর, দোগাছিসহ কয়েকটি গ্রামের মাঠ এখন পেঁয়াজের সাদা ফুলে ছেয়ে গেছে। সেই ফুলে হাতের ছোঁয়ায় কৃত্রিম পরাগায়ন করছেন চাষিরা। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পরাগায়ন করতে হয় পেঁয়াজ ফুলের। বিকেলে চলে সেচের কাজ।
চাড়োল গ্রামের আনসার আলী গত বছর ৮ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেছিলেন, এবার করেছেন ১২ বিঘায়। ফাল্গুনের শুরুতেই ক্ষেতে কৃত্রিম পরাগায়ন শুরু করেছেন। তিনি জানান, পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে চাড়োল গ্রামের কমপক্ষে ৫০ কৃষক কোটিপতি হয়েছেন। অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পেয়েছে ৭০০-৮০০ জন।
ধুকুরঝাড়ী গ্রামের সুদেব পাল জানান, কয়েক বছর ধরে তিনি পেঁয়াজ বীজের চাষাবাদ করছেন। পরিবারের সবাই মিলে কাজ করেন ক্ষেতে। তাই শ্রমিক লাগে না তার। গত বছরের মুনাফা দিয়ে পাকা বাড়ি তুলেছেন। এ বছর সেই বাড়ি প্লাস্টার, চারপাশের সীমানাপ্রাচীর দেবেন।
বালিয়াডাঙ্গী চৌরাস্তা বাজারে মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, ইজিবাইকসহ নানা যানবাহনের যন্ত্রাংশের ব্যবসা আছে অপুর। ব্যবসা বন্ধ রেখে চলতি বছর প্রায় ১১ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজ আবাদ করেছেন। তিনি জানান, ব্যবসা বন্ধ রেখে দিনমজুরদের নিয়ে সাড়ে ৪ মাস ধরে তিনি মাঠেই কাজ করছেন।
অপুর মতো অনেকেই ব্যবসা, চাকরি ছেড়ে মনোযোগ দিয়েছেন পেঁয়াজের বীজ আবাদে। বেকারত্ব ঘুচেছে অনেকের। চাকরি মেলেনি, ২ বছর আগে কৃষিকাজে নেমেছেন চাড়োল গ্রামের বিপ্লব রানা। এবার পেঁয়াজ বীজের আবাদ করেছেন ১৬ বিঘায়। তিনি জানান, ৬ মাস পরিশ্রম করে পেঁয়াজ বীজটা বিক্রি করতে পারলেই কমপক্ষে ৩৫ লাখ টাকা লাভ হবে। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেই উদ্যোক্তা হয়েছেন। প্রতিদিন তার ক্ষেতে কাজ করছেন ২০ শ্রমিক।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন সোহেল কালবেলাকে বলেন, চাড়োল গ্রামের চাষিদের দেখে ঠাকুরগাঁওয়ে পেঁয়াজ চাষ কয়েকগুণ বেড়েছে। এটা চাড়োল গ্রামের চাষিদের বড় অর্জন। আমরা কৃষকদের পাশে থেকে নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা করছি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে প্রায় ১২০ কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করতে পারবেন চাষিরা।
মন্তব্য করুন