মানিকগঞ্জের সিংগাইর থানার ওসি মো. জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার (০৪ মার্চ) বিকেলে মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোছা. ইয়াসমিন খাতুন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে সহকারী পুলিশ সুপার (সিংগাইর সার্কেল) নাজমুল হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি গণমাধ্যমকে ওসির প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর মানিকগঞ্জের সিংগাইরে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলাসহ ৪টি মামলা দায়ের হয়। পাঁচ আগস্ট পরবর্তী সময়ে পুলিশ ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের অধিকাংশই আসামি মামলার এজাহারে নাম না থাকায় অজ্ঞাত আসামি হিসেবে আটক করা হয় তাদের।
এজাহারে তাদের নাম না থাকলেও আটকের পর পুলিশ তাদের কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। এমনকি হত্যা মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। চাহিদামতো টাকা দিলেই ফাঁড়ি ভাঙচুর কিংবা বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। না দিলে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়।
সিংগাইর থানার ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর তার পছন্দের এসআই দিয়ে থানায় গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট বাহিনী। তাদের দিয়েই গত ৬ মাসে কামিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। ওসি ও তার সিন্ডিকেট বাহিনীর গ্রেপ্তার বাণিজ্যের তথ্য উঠে এসেছে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওসির গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন এসআই সুমন চক্রবর্তী, মুত্তালিব ও মাসুদুর রহমান। এদের মধ্যে এসআই সুমন চক্রবর্তীকে শিবালয় থানায়, এসআই মুত্তালিবকে দৌলতপুর থানায় ও এসআই মাসুদকে ঘিওর থানায় বদলি করা হয়েছে। এসআই সুমন চক্রবর্তী ও এসআই মুত্তালিব এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় যোগদান করলেও এসআই মাসুদুর রহমানকে বদলির পরেও ওসি বিশেষ ক্ষমতায় থানায় রেখে গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালিয়ে যায়। এদিকে নানা অপকর্মে জড়িত থাকায় ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরকে তিনবার শোকজ করার পর অবশেষে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ক্লোজড করা হয়।
গ্রেপ্তার বাণিজ্য নিয়ে বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সিংগাইর থানায় কর্মরত এসআই সুমন চক্রবর্তী ওসি জাহিদুল ইসলামের যোগসাজশে বিভিন্ন মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তিকে আটক করে। আটক ব্যক্তিদের হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে তাদেরকে জামিনযোগ্য মামলায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠায়।
বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু ঘটনার তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখিত বেশ কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে তার সত্যতা পাওয়া যায়। গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে সিংগাইর থানার তালেবপুর ইউনিয়নের কাংশা গ্রামে মুক্তার হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে চুরির অপরাধে আটক করে স্থানীয়রা। এরপর রাতভর তাকে নির্যাতন করা হলে পরদিন সকালে তিনি মারা যান। এ ঘটনায় ১৫ সেপ্টেম্বর মামলা করেন মুক্তার হোসেনের ছেলে আশিকুর রহমান। ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে প্রান্ত, নবু ও যুবায়ের নামে তিনজনকে আটক করে এসআই সুমন চক্রবর্তী। পরে ওসির নির্দেশে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জামসা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মো. আতিককে আটক করে এসআই সুমন চক্রবর্তী। তাকে হত্যা ও একাধিক নাশকতা মামলায় গ্রেপ্তারের ভয় দেখানো হয়। পরে এসআই সুমন ওসির সঙ্গে যোগসাজশে আতিকের পরিবারের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
একইভাবে ধল্লা ইউনিয়নের মো. ইউনুসকে আটক করে এসআই সুমন। ইউনুসকেও হত্যাসহ একাধিক মামলায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে ১ লাখ টাকা আদায় করে। পরে ওসির নির্দেশে ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি পোড়ানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
গত বছরের ১৮ অক্টোবর সিংগাইর উপজেলার ভাকুম এলাকার ভাই-ভাই জেনারেল স্টোরের মালিক মো. জয়নালের বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ করে স্থানীয়রা ৯৯৯-এ ফোন করে। পরে ওসির নির্দেশে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন এসআই সুমন ও মাসুদুর রহমান। আটক জয়নালের পরিবারের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে ৫৪ ধারায় তাকে আদালতে পাঠানো হয়।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সিংগাইরের একটি সি.আর মামলার আসামি মীর মো. শাজাহান, মীর বাবু, আতাউল হক ও মো. আমিনকে গত বছরের ২ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে এসআই সুমন। এদের মধ্যে মীর শাহজাহান ও মীর বাবু পিতা-পুত্র। পরে মীর শাহজাহানের সামনে ছেলে মীর বাবুকে থানার ভেতরেই প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়। এসব থেকে রক্ষা পেতে ওসি জাহিদুল ইসলাম ও এসআই সুমনকে দুই লাখ টাকা ঘুষ দেয় তাদের পরিবারের লোকজন। ছাড়া আতাউল হক ও মো. আমিনের পরিবারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ১ লাখ টাকা আদায় করে ওসি জাহিদুল ইসলাম ও এসআই সুমন।
জামির্ত্তা ইউনিয়নের খালিদ মাহমুদ খোকনের পরিবার অভিযোগ করে বলেন, খোকনকে গ্রেপ্তারের পর ৫ লাখ টাকা দাবি করে ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর। ওই টাকা না দেওয়ায় তাকে ২০১৩ সালে গোবিন্দলের হত্যা মামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ড চাওয়া হয়। বর্তমানে সে জামিনে এসে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপনে রয়েছে বলে জানা গেছে ।
অপরদিকে, মামলার এজাহারভুক্ত আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী থানা-পুলিশকে ম্যানেজ করে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিংগাইর থানায় দায়েরকৃত সবগুলো রাজনৈতিক মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয় ওসি জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীরের আস্থাভাজন এসআই সুমন চক্রবর্তী, মুত্তালিব ও মাসুদুর রহমান মাসুদকে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে প্রায় কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।
মন্তব্য করুন