নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে কবির হোসেন নামে এক যুবক ভাগ্য ফেরাতে প্রবাসে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন। সোমবার (৩ মার্চ) সকালে শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চরকিশোরগঞ্জ এলাকায় তার বাড়িতে লাশ নিয়ে আসা হয়। এ সময় এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতরণা হয়।
নিহত কবির হোসেন উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চর কিশোরগঞ্জ গ্রামের মো. আবুল কাশেমের ছেলে। তার দুই ছেলে, তিন মেয়ে।
জানা গেছে, ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে পরিচিত এক দালালের মাধ্যমে কবির হোসেন ঢাকার পুরানা পল্টনের বিকে ইন্টারন্যাশনাল লির্বাটি ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড নামের একটি এজেন্সির মাধ্যমে ২০২৪ সালের ১৩ মে তিনি উজবেকিস্তান যান। সেখানে তাকে আটকে রেখে মুক্তিপণের জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। অনাহার ও নির্যাতনে তিনি গত ১৩ জানুয়ারি মারা যান। পরিবার মুক্তিপণের ৮০ হাজার টাকা দিয়েও বাঁচাতে পারেননি কবির হোসেনকে। টাকা পাঠাতে দেরি হওয়ায় তার ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়। কবির হোসেনের ভাগ্য তো ফিরলো না, লাশ হয়ে ফিরলেন নিজ বাড়িতে।
এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী কহিনুর বেগম বাদী হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি সোনারগাঁ থানায় দুইজনকে আসামি করে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের পর পুলিশ তদন্ত তো দূরের কথা ফোনেও তাদের সঙ্গে কথা বলেননি।
নিহতের বড় ভাই এবাদুল্লাহ জানান, তারা ৫ ভাই। ভাইদের মধ্যে কবির হোসেন আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল। বাড়িতে থাকাবস্থায় সে রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি, অল্প পুঁজিতে মুদি ব্যবসা, কখনো অটোরিকশা চালাতেন। বিভিন্ন এনজিও অথবা নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে গ্রামীণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাপে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আত্মীয় স্বজন ও এনজিও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ, কর্জ নিয়ে গত বছরের ১৩ মে একটি বিমান ফ্লাইটে উজবেকিস্তান যান। সেখান থেকে তার তুরস্ক যাওয়ার কথা ছিল। তুরস্ক নেওয়ার কথা বলে সেখানে একটি কক্ষে নিয়ে মুক্তিপণের জন্য আটকে রেখে নির্যাতন করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে আকুতি জানায়। আর্থিক দুরবস্থার পরিবার টাকা যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিল। এক পর্যায়ে একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকা গত ১২ জানুয়ারি রাসেল নামের একজনের মাধ্যমে সেখানে পাঠায়। টাকা পাঠানোর পরদিন কবির হোসেনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর লাশ আনতে গড়িমসি শুরু করে।
বিষয়টি নিয়ে সোনারগাঁ থানায় অভিযোগ দায়েরের পর আদম ব্যবসায়ী মো. জাহিদ মিয়া বিদেশ যাওয়ার ৮ লাখ টাকাসহ লাশ আনতে রাজি হন। দীর্ঘ ৪৮ দিন পর আজ (সোমবার) সকাল সাড়ে ৫টার একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে লাশ আসে। সেখানে তিনি লাশ গ্রহণ করেন। এরপর বাদ যোহর চরকিশোরগঞ্জ মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা মাঠে জানাজা শেষে পঞ্চায়েত কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
এদিকে উজবেকিস্তান কবির হোসেনের মৃত্যুর পর থেকে বিকে ইন্টারন্যাশনাল লির্বাটি ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেড নামের এজেন্সির মালিক মো. কালাম মান্নানসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের অফিসে তালা ঝুলিয়ে আত্মগোপনে যায়। সেখানে নিহতের পরিবার একাধিকবার গেলে তাদের অফিস বন্ধ পান। তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও বন্ধ পাওয়া যায়।
নিহতের ফুফাতো ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, কবির হোসেনের দুই ছেলে, তিন মেয়ে। আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে ভাগ্য ফিরাতে বিদেশ গিয়েছিল। কে জানতে তার এ পরিণতি হবে। তার দুচালা ঘরের দরজা পর্যন্ত নাই। পুরানো কাপড় ঘরের দরজা হিসেবে ব্যবহার করে। কবিরের মৃত্যুতে তার পরিবার অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।
নিহতের স্ত্রী কহিনুর বেগম জানান, তুরস্ক যাওয়ার জন্য ৮ লাখ টাকা জমা দিয়ে উজবেকিস্তান নেওয়ার পর তাকে একটি কক্ষে নিয়ে টাকার জন্য প্রতিদিন মারধর করা হয়। প্রতিদিন মোবাইল ফোনে আমাদের কাছে কান্না করতো। দ্রুত টাকা পাঠিয়ে তাকে তাদের কাছ থেকে মুক্ত করতে। তাকে তেমন খাবার দিত না। বরফের পানি খেয়ে ও তাদের নির্যাতনে সে মারা যান। বলতে বলতে তিনি এক পর্যায়ে মূর্ছা যান। বিরতি নিয়ে আবার বলেন, একটি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই রাসেল নামের একজনের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছি। রাসেলও সেই টাকা নির্যাতনকারীদের দেয়নি। আমাদেরও ফেরত দেয়নি। আমার ৫ সন্তান নিয়ে এখন সাগরে পরে আছি। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।
সোনারগাঁ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় কুমার বসাককে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সোনারগাঁ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রাশেদুল হাসান খাঁন বলেন, অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তিনি কোর্টে মামলা করার পরামর্শ দেন। কী কারণে এসআই যাননি এ বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (খ-অঞ্চল) আসিফ ইমাম বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্তব্য করুন