বিশ্বে গর্ব করার মতো বাংলাদেশের আছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ স্থাপত্যকলা। শিল্পের এই মাধ্যমে কোনো অংশে কম ছিল না এ অঞ্চল। বাংলাদেশের যে স্থাপত্যশৈলী এখনো বিমোহিত করে চলেছে অগণিত ভ্রমণচারী ও মননশীল মানুষকে, তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ।
১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এ আন্দরকিল্লার অন্দরে বা ভেতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় ‘আন্দরকিল্লা’। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে নির্মাণ করেন ‘আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ।’ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটিকে বলা হয় মুঘল বিজয়ের স্মারক। প্রায় ৩৫৯ বছরের পুরানো এ মসজিদ এখন কালের সাক্ষী। বৃহত্তর চট্টগ্রামের একসময়ের একমাত্র জুমা মসজিদ হিসেবে খ্যাত এই মসজিদ সবার কাছে আবেগ ও ভালোবাসার নাম।
বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৬৪০-১৬৬০ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন মোগল বাদশাহ শাহজাহানপুত্র শাহজাদা সুজা। ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের কাছে পরাজয়ের পর শাহজাদা সুজা বিপুল সংখ্যক ধনরত্ন নিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন আরাকান রাজ্যে। কিন্তু ছয় মাসের মাথায় শাহজাদা সুজাকে খুন করে আরাকান রাজা। মোগল পরিবারের মেয়েদের করা হয় লাঞ্ছিত এবং ছেলেদের করা হয় কারারুদ্ধ। এ বিয়োগান্ত সংবাদ অচিরেই পৌঁছে যায় দিল্লি বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীরের কাছে। যদিও এর অনেক আগ থেকেই ইউরোপীয় জলদস্যুদের সহযোগিতায় মগদস্যুদের অত্যাচার ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো বাংলাজুড়ে। এরা ছিল মূলত পর্তুগিজ নৌ-দস্যুদের রাজাকার বাহিনী। মগদের দস্যুতার কারণে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত বিভিন্ন নদীর দুই তীর প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে পড়েছিল। তারা স্থানীয় লোকজনকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবেও বিক্রি করতো।
শাহজাদা সুজার পর তার সব সন্তানাদিকেও হত্যা করে মগ দস্যুরা। ভিনদেশি কারও হাতে ভাইয়ের খুন, নিজ পরিবারের স্ত্রী-সন্তানের সম্ভ্রম লুটকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব। আরাকান রাজার হাতে নিজ ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে তাই নিজ মামা ও দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহচর শায়েস্তা খাঁকে বাংলার সুবেদার করে পাঠান তিনি।
এ অভিযানে প্রধান সেনানায়ক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সুবেদার শায়েস্তা খাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ আলি খাঁ। অভিযানের শুরুতে ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ওলন্দাজদের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় সন্দ্বীপ দখল করে মোগলরা। তৎকালীন সময়ে মগদের কেন্দ্র ছিল চাটগছার আন্দরকিল্লা। দ্বিমুখী আক্রমণে ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি পতন ঘটে আন্দরকিল্লার।
বুজুর্গ উমেদ আলি খাঁ আন্দরকিল্লা পতনের পর চট্টগ্রামের নামকরণ করেন ইসলামাবাদ। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক চিহ্ন হিসেবে মগদের ফেলে যাওয়া কিল্লার ওপরে ১৬৬৭ সালে নির্মাণ করেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। মসজিদের দুয়ারে ফারসি ভাষায় লেখা হয় ‘হে জ্ঞানী, তুমি জগতবাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি।’ কালো পাথরের শিলালিপি আজও সাক্ষ্য দেয় সেই ইতিহাসের।
মসজিদের শিলালিপিতে বাংলার মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁন এটি নির্মাণ করেন বলে উল্লেখ আছে। যদিও ধারণা করা হয়, এ মসজিদের প্রকৃত নির্মাতা শায়েস্তা খানের বড় ছেলে ও চট্টগ্রাম বিজেতা উমেদ খাঁন। তবে তার নাম ওই শিলালিপিতে উল্লেখ নেই।
শুধু স্থাপত্য নিদর্শনই নয়, স্থাপত্য অনন্য শৈল্পিক দিক থেকেও মসজিদটি এ অঞ্চলের এক অনন্য পুরাকীর্তি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের আদলে মোগল স্থাপত্যরীতি অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। মসজিদের বিশাল আঙিনা, কারুকার্যখচিত খিলান আর গম্বুজ দেখলে পারস্যরীতির স্থাপত্যশৈলীর কথাও মনে পড়বে। দিল্লি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত বলে এই মসজিদকে ‘পাথরের মসজিদ’ও বলা হয়ে থাকে।
সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট ওপরে ছোট একটি পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। মূল মসজিদের নকশা অনুযায়ী এটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) দীর্ঘ। প্রস্ত ৭ দশমিক ৫ গজ (৬.৯ মিটার)। প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২ দশমিক ৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি, নান্দনিক টেরাকোটা সমৃদ্ধ এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মসজিদটির পূর্বে ৩টি ও উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মেহরাব থাকলেও সাধারণত মধ্যখানের ও সর্ববৃহৎ মেহরাবটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মসজিদটির ছাদে ৩টি গম্বুজ মসজিদের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ৪টি অষ্টভুজাকৃতি বুরুজের মধ্যে পেছন দিকের দুটি এখনো টিকে আছে।
নির্মাণের পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে আন্দরকিল্লার এ মসজিদ। কিন্তু ১৭৬১ সালে নবাব মীর কাসিম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান মেদিনীপুর জেলাসহ বর্তমান চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেন। ইংরেজরা চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার পর আন্দরকিল্লা মসজিদকে অস্ত্রাগার ও আস্তাবলে পরিণত করে। ১৭৬১ সাল থেকে ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৯৪ বছর তারা এ মসজিদে কোনো ধরনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করতে দেয়নি মুসলমানদের। পরে এর প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করেন তৎকালীন ব্রিটিশ রাজের অধীনস্থ রাজস্ব কর্মকর্তা খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খান। তার এ আন্দোলনের মুখে ১৮৫৬ সালে আন্দরকিল্লা মসজিদ পুনরায় চালু হয়। ১৯৮৬ সাল থেকে মসজিদটির দায়িত্বে রয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শত শত বছর পর ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে মসজিদের পিলার, মিনারসহ বিভিন্ন অংশ। ফাটল ধরেছে দেয়ালে। বাইরে বৃষ্টি হলেই কিছু কিছু জায়গায় চুপসে পানি ঢুকে পড়ে মসজিদের ভেতর। ছাদের সিলিং, পিলার ফেটে গেছে বহু আগেই। এদিক সেদিক থেকে বেরিয়ে এসেছে রড-সুড়কি। ছাদ, গম্বুজ, দেয়ালসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। তালগাছের মতো উঁচু যে মিনারগুলো রয়েছে সেগুলোর দেয়াল চৌচির হয়ে সৃষ্টি হয়ে বড় বড় ফাটল। দেয়ালে ফাটলের ওপর তাকালেই ফাটা অংশ ভেদ করে দেখা যায় ওপাশের আকাশ। খসে পড়া বিভিন্ন অংশ পড়ে থাকে মাটিতে। এ যেন শুধু মসজিদের অবকাঠামো নয়, খসে পড়ছে ঐতিহাসিক মুঘল বিজয়ের স্মারক।
মসজিদটির মুসল্লি পরিষদের সভাপতি সালাউদ্দিন কাশেম খান কালবেলাকে বলেন, এটা সরকারের অধীনে হওয়ায় কোনো সংস্কার কাজও করা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে কিছু ছোটখাটো কাজ করি আমরা। কিন্তু যদি অনুমতি পাওয়া যায় তাহলে সবার সহযোগিতায় নতুন মসজিদ কিংবা পুরানো মসজিদের অবকাঠামো ঠিক রেখে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা সম্ভব হবে। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব প্রাচীনতম এই মসজিদ ও স্থাপত্য রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হোক।
এর আগে ২০২৪ সালের ২২ নভেম্বর দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ পরিদর্শন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মসজিদে নববীর আদলে গড়ে তোলা হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদকে। মুসল্লিদের আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় রেখে এ মসজিদটিকে একটি আইকনিক মসজিদ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এই মসজিদের মূল ভবনটি অবিকৃত রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যায় কি না সেই বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
মসজিদটির জন্য কুয়েত চ্যারিটি ফান্ড হতে প্রাপ্ত ১০ কোটি টাকা মন্ত্রণালয়ের তহবিলে জমা আছে উল্লেখ করে ড. খালিদ সাংবাদিকের বলেন, ‘মসজিদের জায়গার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে যেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসল্লির নামাজের ব্যবস্থা করা যায় সেভাবে নকশা প্রণয়ন করা হবে। কুয়েত চ্যারিটি ফান্ড হতে প্রাপ্ত ১০ কোটি টাকা মন্ত্রণালয়ের তহবিলে জমা আছে। এই টাকা দিয়েই কাজ শুরু করা হবে। এর বেশি টাকা দরকার হলে সেটা ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মন্ত্রণালয়ের তহবিল থেকে সংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। মসজিদের নকশা প্রণয়নের জন্য স্থাপত্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে সয়েল টেস্ট ও ডিজিটাল সার্ভে সম্পন্ন করা হয়েছে। ২০২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হবে এবং চলতি বছরের (২০২৫) জানুয়ারি এ মসজিদের উন্নয়ন কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।’
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. আনোয়ারুল হক কালবেলাকে বলেন, সংস্কার কাজ করতে না পারায় বর্তমানে মসজিদটির অবস্থা আগের চেয়েও আরও বেশি জরাজীর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংস্কারের অভাবে মসজিদের একটি ফ্লোরে নামাজ আদায়ও বন্ধ রয়েছে ১০ বছর ধরে। বৃষ্টি হলেই দেয়াল বেয়ে পানি প্রবেশ করে মসজিদের ভেতরে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন পরিদর্শন করে যাওয়ার পর এখন অনেক ফলোআপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্থাপত্য অধিদপ্তর থেকে অনেকেই কিছুদিন পরপর এসে পরিদর্শন ও পরিমাপ করে যাচ্ছেন।
এই বিষয়ে কথা হয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সদ্য সাবেক বিভাগীয় পরিচালক বোরহান উদ্দিন মো. আবু আহসানের সঙ্গে। কালবেলাকে তিনি বলেন, আমি গত ফেব্রুয়ারির মাস পর্যন্ত চাকুরি করেছি। এই মাস থেকে অবসরে রয়েছি। স্থাপত্য অধিদপ্তর বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আমি যতটুকু জানি, নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ হতে মার্চ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এরপর বাকি প্রসেসিং সামনে আসবে।
অন্যদিকে এই বিষয়ে কথা বলতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভাগীয় পরিচালক সরকার সরোয়ার আলমকে বেশ কয়েকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাই তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
মন্তব্য করুন