ছত্রাকের আক্রমণ থেকে পেঁয়াজের গাছ ভালো রাখতে ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করেছিল চাষিরা। সেই কীটনাশকেই পেঁয়াজের সর্বনাশ। পচে গেছে বিঘার পর বিঘা পেঁয়াজ। মাথায় হাত চাষিদের। এমনকি পেঁয়াজের সাথে সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা কচু ও কলাগাছও মরে গেছে।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জাহাজপোতা গ্রামের কৃষক সেলিম উদ্দিন। তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করেছেন। এই চাষে লাখ টাকা খরচ জোগাতে নিজের পোষা গরু বিক্রি করেছিলেন। আশা ছিল এবার পেঁয়াজের ফলন ও দামে বেশ লাভবান হতে পারবেন। তবে তার সেই স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে কীটনাশক কোম্পানি। মার্শাল কোম্পানির য়োকরাল কীটনাশক স্প্রে করে পেঁয়াজ গাছে লেগেছে পচন। তার মতো একই অবস্থা কিষানি রেবেকা আক্তার রুনার। পেঁয়াজের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা কচু, কলাগাছও মরে গেছে।
জানা গেছে, উপজেলার জাহাজপোতা, হুদাপাড়া, হরিরামপুর, মুন্সিপুর মাঠে ১৬ জন কৃষকের প্রায় ২০ বিঘা জমির পেঁয়াজ মার্শাল কোম্পানির কীটনাশক স্প্রে করাতে পচন লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। হুদাপাড়া গ্রামের কীটনাশক বিক্রেতার কাছ থেকে মার্শাল কোম্পানির য়োকরাল নামের কীটনাশক কিনে ক্ষেতে স্প্রে করেছিল ভুক্তভোগী কৃষকরা।
সরেজমিন চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ২০ জন পেঁয়াজ চাষি তাদের পেঁয়াজ ক্ষেতে মার্শাল এগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ উৎপাদিত য়োকরাল নামক ছত্রাকনাশক স্প্রে করেন। এর ফলে তাদের প্রায় ৩০ বিঘা জমির পেঁয়াজ পচে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
চাষিরা জানান, তাদের ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার মতো। বিঘাপ্রতি পেঁয়াজ চাষে তাদের খরচ হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকার মতো। অপরদিকে তাদের ফলন হওয়ার কথা প্রতি কাঠায় ৮ মণ হিসেবে বিঘায় প্রায় ১৬০ মণ। গড়ে ২ লাখ টাকার উপরে তাদের মুনাফা হতো। আর মাত্র এক মাস পরেই তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ ওঠার কথা। এখন তাদের মাথায় হাত। এমন অবস্থায় ছেলে-মেয়ে নিয়ে তারা পথে বসে পড়েছেন। তার উপরে আছে বিভিন্ন এনজিও এবং মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে নেওয়া ঋণের বোঝা।
জাহাজপোতা গ্রামের পেঁয়াজ চাষি কৃষক সেলিম জানান, আড়াই লাখ টাকার গরু বিক্রি করে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। আমার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ হওয়ার নয়। আমার ৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সাড়ে তিন বিঘা পেঁয়াজের জমিতে মার্শাল কোম্পানির য়োকরাল কীটনাশক প্রয়োগ করেছিলাম। আমি এখন মহাজনের এবং এনজিওর ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করব, সেটা ভেবেই চরম অনিশ্চয়তার মাঝে দিন কাটছে আমার। পার্শ্ববর্তী হরিরামপুর গ্রামের আরিফুলের দোকান থেকে কীটনাশক কিনে ব্যবহার করি। কোম্পানির লোক ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজের জমি দেখে গেছে। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা থাকলেও না দিয়ে কালক্ষেপণ করছে। দেখি ক্ষতিপূরণ দেয় কিনা। না দিলে আমি উচ্চপর্যায়ে অভিযোগ করব।
জাহাজপোতা গ্রামের ফয়সালের স্ত্রী রেবেকা রুনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমিও আমার আড়াই লাখ টাকা দামের গরু বিক্রি করে দেড় বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। হুদাপাড়া গ্রামের সারের দোকানদার ইমরানের কাছ থেকে কেনা য়োকরাল বিষ দিয়ে আমার জমিরও পুরো পেঁয়াজ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। আমি এখন পথে বসে গেছি, আমার কি হবে? আমি এর বিচার চাই।
এ বিষয়ে দোকানি আরিফুল বলেন, আমার এ কীটনাশকের ডিলার কার্পাসডাঙ্গা বাজারের ব্রিজ মোড়ের কীটনাশক দোকানি হাসিবুর। আপনি তার সাথে কথা বলেন। আমি শুনেছি এলাকায় আরও অনেক কৃষকের ক্ষতি হয়েছে। কোম্পানি তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
কোম্পানির ডিলার হাসিবুরের সাথে কথা বললে তিনি নিজের দায় এড়িয়ে বলেন, আমি কিছু জানি না। কোম্পানির লোক সব বলতে পারবে। কোম্পানির বড় বড় অফিসার এটা দেখছে। আপনি এই কোম্পানিতে কর্মরত লোকনাথপুর গ্রামের আরিফের সাথে কথা বলেন।
কোম্পানির ফিল্ড অফিসার আরিফুল বলেন, আমরা মাঠে তদন্ত করে একটা তালিকা করেছি। ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তাছাড়াও আমাদের কীটনাশকে ক্ষতি হয়েছে কিনা তার পরীক্ষা চলছে, ক্ষতি হলে আমরা দেখবো।
হুদাপাড়া গ্রামের য়োকরাল ছত্রাকনাশক বিক্রেতা ইমরান আলী বলেন, আমার কাছ থেকে দুজন চাষি য়োকরাল বিষ কিনেছেন। তাতে ক্ষতি হয়েছে কিনা বলতে পারব না, তবে কোনো কোনো কৃষকের ক্ষতি হয়েছে এটা আগের য়োকরালেও হতে পারে। কোম্পানির লোকজন মাঠে গিয়েছে। ডেমো করে তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার তালিকা করেছে এবং তারা ক্ষতিপূরণ পাবে বলে আমি শুনেছি।
কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুন বলেন, আমরা মাঠ তদন্ত করেছি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বলেছি কোম্পানি ক্ষতিপূরণ না দিলে আমাদের উপজেলা কৃষি অফিসে লিখিত অভিযোগ করতে। আমরা কৃষকের পাশে থাকব। ক্ষতিগ্রস্ত পেঁয়াজ চাষি ও ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণের কাজ শেষ হলে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
হুদাপাড়া গ্রামের মৃত নিশিন্দ হালসনার ছেলে মহত আলীর দেড় বিঘা, মৃত সাহাদতের ছেলে ফয়সালের স্ত্রী রেবেকা রুনার দেড় বিঘা, মৃত নাসির কেয়ারের ছেলে কালো কয়ালের ১০ কাঠা, আলিবদ্দিনের ছেলে সাগরের ১০ কাঠা, মৃত ভগার ছেলে খোকনের ১০ কাঠা, দয়লা মোড়লের ছেলে লিটনের ১৫ কাঠা, কার্পাসডাঙ্গার এম.মফিজুর রহমানের ছেলে সাঈদের ১৬ কাঠা, জাহাজপোতা গ্রামের শরীফ উদ্দিনের ছেলে সেলিম উদ্দিনের সাড়ে ৩ বিঘা, মৃত আবেদিনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাকের দেড় বিঘা, হরিরামপুরের শাহজাহান আলী ডাক্তারের ছেলে ছাবদারের ২ বিঘা, মুন্সীপুরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাকের ২ বিঘা জমির পেঁয়াজ সম্পূর্ণ পচে নষ্ট হয়ে গেছে। উল্লেখিত গ্রামগুলোর বেশিরভাগ কৃষক তাদের শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে থাকেন। কারণ এই এলাকার জমি সাধারণত পেঁয়াজ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
হুদাপাড়া গ্রামের পেঁয়াজ চাষি মহত আলী জানান, তারা ভারতীয় সুখসাগর জাতের পেঁয়াজের বীজ এনে প্রতিবছর ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশি কয়েকটি গ্রামের শত শত বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করে থাকেন। কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের বয়রা, হুদাপাড়া, জাহাজপোতা, হরিরামপুর, কুতুবপুর, চন্দ্রবাস, শিবনগর, মুন্সিপুর, আটকবর, কানাইডাঙ্গা গ্রামের পেঁয়াজ চাষিদের মাথায় হাত। প্রায় ৩০-৪০ বিঘা জমির পেঁয়াজ পুড়ে শেষ। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও জেলা কৃষি কর্মকর্তার অবশ্যই মাঠ পর্যায়ে এসে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সেই সাথে কোম্পানি শুধু ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাতে দায়মুক্তি না পায় কৃষকের সাথে প্রতারণা করায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানান তিনি। একই গ্রামের পেঁয়াজ চাষি কাউল হোসেন বলেন, আমি ৪ লাখ টাকা খরচ করে আমার জমিতে চাষ করেছিলাম। এর সবটাই পচে গেছে বিষ দিয়ে। এটা এখন আর হবে না।
এ ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, আমরা শুনেছি এবং সরেজমিন ক্ষতিগ্রস্ত মাঠ পরিদর্শন করেছি। ঘটনার সাথে জড়িত কীটনাশক কোম্পানির কর্মকর্তাদের ডেকে কথা বলেছি, তারা আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। আমি আশা করব তারা শীঘ্রই ক্ষতিপূরণ দিবে। না হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় ৭ হাজার ৩৩৫ বিঘা জমিতে সুখসাগর ও তাহেরপুরী জাতের পেঁয়াজের চাষ হয়েছে। এর থেকে ৩০ হাজার ৭৭০ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
মন্তব্য করুন