বাংলার প্রাচীন রাজধানী হিসেবে পরিচিত সোনারগাঁ। বারো ভূঁইয়া ও প্রাচীন ঐহিহ্যের নানা নিদর্শন আজও বিদ্যমান এই জনপদে। পুরোনো রাজধানী হিসেবে সোনারগাঁয়ের পরিচিতি রয়েছে সারা দেশে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে এই উপজেলায়।
কালের বিবর্তনে রাজধানী হারিয়ে গেলেও পুরোনা অনেক নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদ আজও বিদ্যমান সোনারগাঁয়ের আনাচে কানাচে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুপরিচিত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বারদীর চৌধুরীপাড়া গ্রামে। ওই বাড়িতেই কেটেছে তার শৈশব। স্মৃতিবাহক জ্যোতি বসুর এ বাড়িকে ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে ঘোষণা দেন।
পরে ৩ কোটি ৮৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যায়ে সংস্কার করে ২০২০ সালে সাবেক বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন তা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। তবে কালের বিবর্তনে বাড়িটির আদি পাকা ভবনটি প্রায় বিলীনের পথে। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পর্যটন কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে আছে জরাজীর্ণ বাড়িটি৷ যার ফলে সোনারগাঁয়ের বারদী থেকে প্রায় মুছে যেতে বসছে জ্যোতি বসুর নাম।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাড়িটিতে মাত্র তিনজন কর্মকর্তা আছে। এলাকার সবাই চান, জ্যোতি বসুর বাড়িটি বড় যত্নে থাকুক। সরকার এর দেখভাল করুক। বাড়িটি থাকলেই থেকে যাবে জ্যোতি বসুর নাম। সারা বিশ্বে সুপরিচিত ও ধীর হবে বাংলাদেশের নাম।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বহু দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে ভ্রমণ প্রিয়সী মানুষ, বাড়িটি দেখতে ছুটে আসেন। এই নিদর্শনটি আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। কিন্তু যথাযথ পরিচর্যার অভাবে বিলীন হতে চলেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মতিউর রহমান বলেন, বাড়িটি বর্তমানে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর অস্তিত্ব বিলীনের পথে।
বারদী এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ মুজিবুর রহমান বলেন, জ্যোতি বসুর বাড়িটি বহু বছর আগে সরকার পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করে লাইব্রেরিসহ অন্যান্য ভবন নির্মাণ করলেও বাড়িটি অরক্ষিত অবস্থায় আছে। বাড়িটি সংস্কার করলে হয়তো পর্যটকদের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।
প্রসঙ্গত, জ্যোতিবসু সেন্ট জেভিয়ার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর লন্ডন গিয়ে জ্যোতি বসু বার এট ল পাস করেন। ১৯৪০ সালে কলকাতা ফিরে আসেন এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি রাজ্য পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালে জ্যোতি বসু ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া মাকর্সবাদী বা সিপিএম এর সদস্য হিসেবে ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছর একটানা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসু ১৯৮৭ সালের ২০ জানুয়ারি এবং ১৯৯৭ সালের ১১ নভেম্বর স্ত্রী বাসন্তি ঘোষ ওরফে কমলা বসু ও তার ছেলে চন্দন বসুকে সঙ্গে নিয়ে বারদীতে তার পৈতৃক বাড়িটি দেখতে আসেন। ওই সময় জ্যোতি বসুর সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান।
পরে ১৯৯৭ সালে জ্যোতি বসুর সঙ্গে বারদীতে আসেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। সে সময় ভারত থেকে জ্যোতি বসুর সঙ্গে আসেন পশ্চিমবঙ্গের উপমুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসুর বড় ভাই ডা. সুরেন্দ্র কিরণ বসু এবং বোন সুধা বসুও।
সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা রহমান বলেন, আমরা বইয়ে জ্যোতি বসুর ইতিহাস পড়েছি। সোনারগাঁয়ে জ্যোতি বসুর বাড়িটি জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে। এখানে উপজেলা প্রশাসনের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা নেই। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কাজ করা শুরু করলে হয়তো জ্যোতি বসুর বাড়িটি পর্যটক বান্ধব হয়ে উঠবে। এখানে জনবল নিয়োগ দিতে হবে। পর্যটকদের আকর্ষিত করতে কীভাবে সংস্কার করে আদিরূপ ফিরিয়ে আনা যায় সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।
মন্তব্য করুন