পতিত শেখ হাসিনার চাচাতো পাঁচ ভাই থাকতেন খুলনার শের-ই-বাংলা রোডের যে বাড়িটিতে সেটি শেখ বাড়ি নামেই পরিচিত। এই বাড়িতে বসেই খুলনার রাজনীতি থেকে প্রশাসন, টেন্ডারবাজি থেকে নিয়োগ বাণিজ্য সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করা ভিসি ড. ফায়েকুজ্জামান এবং ড. মাহমুদ হোসেন শেখ বাড়ির সঙ্গে সিন্ডিকেট করে কয়েকশ ছাত্রলীগ, যুবলীগকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভিসিদের স্বজনদেরও নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়েছেন দেদারসে। এসব অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য এবং উন্নয়নকাজে দুর্নীতির কারণে দুদকের জালে ফেঁসে যাচ্ছেন সাবেক এই দুই ভিসি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গত বছরের ২০ আগস্ট পদত্যাগ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন। দায়িত্ব পালনের তিন বছরে আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মীয়স্বজন ও দলীয় কর্মীদের অবৈধভাবে নিয়োগ পদোন্নতি ও আপগ্রেডেশন দিয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের ১ নভেম্বর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক মোহাম্মদ ফায়েকউজ্জামান। পরে ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মেয়াদে টানা প্রায় এক দশক ভিসির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ৭১ এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি খুলনা ও গণহত্যা যাদুঘরের মুখপাত্র হিসেবে খুলনায় আওয়ামীপন্থি বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্ব দিতেন তিনি। তার সময় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ বিতর্কিত নিয়োগ বাণিজ্য ছাত্রলীগ, যুবলীগের কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই চাকরি এবং পদোন্নতি ও আপগ্রেডেশন দেওয়া হয়েছে কয়েকশ।
এবার এসব অনিয়ম দুর্নীতির কারণে ফেঁসে যাচ্ছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই দুই ভিসি। তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার সমন্বিত জেলা কার্যালয় খুলনার উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে চার সদস্যের টিম গঠন করা হয়েছে। উন্নয়ন কাজের বিষয়েও পৃথক তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। ইতোমধ্যে বর্তমান উপাচার্যের কাছে সাবেক এই দুই ভিসির সময়কার নিয়োগ পদোন্নতিসহ সব তথ্য তলব করা হয়েছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাড়ে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ হয়। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি হয়েছে। খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক এবং সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন ও শেখ সালাহ উদ্দিন জুয়েলের নির্দেশেই দলীয় কর্মী ও তাদের স্বজনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উপাচার্য ও প্রভাবশালী কর্মকর্তারাও তাদের স্বজনদের নিয়োগ দিয়েছেন। এর বাইরে আগে নিয়োগ পাওয়া ছাত্রলীগ নেতারাও অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি ও আপগ্রেডেশন নিয়েছেন।
এর মধ্যে হত্যা মামলায় সাজা পাওয়ার পরও অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক মুজিবুর রহমানকে পদোন্নতি দিয়েছেন সাবেক উপাচার্য মাহমুদ হোসেন। উপাচার্যের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সঞ্জয় সাহাসহ অন্তত ১৯ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রকৌশলীকে অনিয়মের মাধ্যমে আপগ্রেডেশন দেওয়া হয়।
তথ্য চেয়ে উপাচার্যের কাছে চিঠি দেওয়ার বিষয় স্বীকার করে দুদক খুলনার উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ কালবেলাকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সাবেক ভিসি ড. ফায়েকুজ্জামান এবং ড. মাহমুদ হোসেন -এর কার্যকালে পদোন্নতি নিয়োগ সংশ্লিষ্ট সব তথ্য চাওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মাহমুদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ইচ্ছে করলে কাউকে নিয়োগ বা পদোন্নতি দেওয়া যায় না। প্রতিটি নিয়োগেই কমিটি ছিল, তারা যাচাই-বাছাই করেছে, পরীক্ষা নিয়েছে, সব বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ দিয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।
খুলনার নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাড. বাবুল হাওলাদার বলেন, বিগত সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয় আইনের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের স্বজন ও দলীয় কর্মীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সব অবৈধ নিয়োগের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন