বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের প্রতিনিধি সভায় হিন্দু সম্প্রদায়ের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জানমাল রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রংপুরের ধাপ হরিসভা মন্দিরে পূজা পরিষদের বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় অংশ নিয়ে এ কথা বলেন তারা। এ সময় বক্তারা আরও বলেন, সনাতনীরা এ দেশের সন্তান। আমরা পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তি ও স্বচ্ছন্দে এ দেশেই জীবন যাপন করতে চাই। এজন্য আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। আমরা অন্যায় করব না এবং যেন অন্যায়ের শিকার না হই সে নিশ্চয়তা চাই।
দিনভর অনুষ্ঠিত সভায় অংশ নেন রংপুর বিভাগের অন্তর্গত ৮ জেলার একটি মহানগর, ৫৮ উপজেলা ও দুই পৌরসভা কমিটির আড়াই শতাধিক প্রতিনিধি। তারা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে নিজেদের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি, নানা সংকট ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন।
রংপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রামজীবন কুন্ডুর সভাপতিত্বে ও মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট প্রশান্ত কুমার রায়ের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিষদের সহ-সভাপতি ও সাবেক সিনিয়র সচিব অশোক মাধব রায়। প্রধান বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা। স্বাগত বক্তব্য দেন পরিষদের রংপুর মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি স্বপন ভট্টাচার্য ও জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পার্থ বোস। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল রায় ও গোপাল দেবনাথ, সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর হালদার, সহ-প্রচার সম্পাদক অনয় মুখার্জি প্রমুখ।
সভার শুরুতে পরিষদের প্রয়াত নেতাদের আত্মার শান্তি কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর তৃণমূল থেকে আসা প্রতিনিধিরা নিজেদের কথা তুলে ধরেন। তারা বলেন, ৫ আগস্টের পর তাদের এলাকায় সনাতনীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে হামলার শিকার হয়েছে। মামলার আসামী করা হয়েছে হাজারো সনাতনীকে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকার পরও স্রেফ ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে অনেককে আওয়ামী লীগ ট্যাগ লাগিয়ে মামলায় জড়ানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন অনেকে। বর্তমানে অনেকে নীরব চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন বলেও দাবি করেন কয়েকজন প্রতিনিধি। এসব সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।
সভায় পূজা পরিষদের লালমনিরহাট জেলা শাখার সহ-সভাপতি জগন্নাথ ঘোষ বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তার জেলায় ১০৯টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৫ কোটি ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে সেই প্রশ্ন তোলেন জগন্নাথ।
দিনাজপুর থেকে আসা এক নেতা জানান, পূজা পরিষদের চিরিরবন্দর ও বিরল উপজেলা শাখার সভাপতি এবং সদরের সাধারণ সম্পাদকসহ জেলা শাকার অনেকে মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
গাইবান্ধার এক নেতা জানান, তার জেলায় কেবল ৫ ও ৬ আগস্টের মামলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের অর্ধ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এখনো তারা হামলা-চাঁদাবাজির শিকার। এমনকী হিন্দুদের পুকুর থেকে মাছ পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশে একাধিক প্রতিনিধি বলেন, পূজা উদযাপন পরিষদ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। সনাতনীদের অধিকার আদায়ে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্ত সংগঠনের অনেকে রাজনৈতিক সংগঠনের সম্পৃক্ত থাকায় সনাতনীরা পড়েছেন জটিলতায়। তাই আগামীতে রাজনৈতিক পরিচয়ধারীদের পূজা পরিষদের শীর্ষ পদে না রাখার দাবি জানান তারা। একই সঙ্গে পূজা উদযাপন পরিষদকে তারা কারও লেজুড়ভিত্তিক সংগঠন হিসেবে দেখতে চান না বলেও জানান।
প্রতিনিধিদের সমস্যা সংকট ও দাবির কথা শোনার পর কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের বক্তব্যে বলেন, সনাতনীরা শান্তিপ্রিয় সম্প্রদায়। তারা বিশৃঙ্খলা বিশ্বাস করে না। সনাতনীরা বিশ্বাস করে মাতৃভূমি স্বর্গের চেয়ে প্রিয়। সনাতনীরা অন্য কোন ধর্মের মানুষের ওপর হামলা করেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা ঘটেনি। এরপরও নির্বাচলকালীন সময়ে কিংবা সরকার পরিবর্তনের পর সনাতনীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে এ প্রবণতা আজও চলমান। কোনো সরকার আমলেই হিন্দুদের ওপর হামলার বিচার হয়নি।
পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা হিন্দু সম্প্রদায়ের তৃণমূলের সংগঠকদের উদ্দেশে বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রত্যেকটি ঘটনার জন্য নিকটস্থ থানায় যান। সেখানে মামলা নিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আদালতে যান। সেখানেও মামলা না নিলে আর্মি ক্যাম্পে যান, সেখানে আপনাদের কথা বলুন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় হামলা ও নির্যাতনের শিকার হিন্দুদের সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেছে সেনাবাহিনী। এবং তারা সনাতনীদের জান মাল রক্ষায় তারা পাশে থাকবে। এরপরও প্রতিকার না পেলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
কেন্দ্রীয় নেতারা আরও বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা পূজা উদযাপন পরিষদে থাকতে পারবেন কিন্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হতে পারবে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অশোক মাধব রায় বলেন, সনাতনীদের কথা শুনতে আমরা বিভাগে বিভাগে যাচ্ছি। তাদের সমস্যার কথাগুলো শুনছি। সভাগুলো অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। বিভাগীয় সমাবেশ শেষে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে এবং সনাতনীদের সমস্যাগুলোর প্রতিকারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মন্তব্য করুন