প্রতিদিন রাত ১২টা বাজলেই বগুড়া শহরের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের থানার পাশে একটি হোটেলের সামনে ভিড় করেন ছিন্নমূল, অসহায় মানুষ। প্রতি রাতে তাদের মুখে খাবার তুলে দেয় হোটেলটি। ১১৪ বছর ধরে চলা এ অভ্যাস যেন রীতিতে পরিণত হয়েছে। অভুক্ত ভিক্ষুক ও দরিদ্র মানুষদের মধ্যে প্রতি রাতে বিনামূল্যে খাবার বিতরণ করে থাকে জেলার ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী প্রতিষ্ঠান আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল।
জানা গেছে, হোটেলের বাসি বা উচ্ছিষ্ট খাবার নয়, একেবারে আলাদাভাবে নতুন করে রান্না করা খাবার বিতরণ করা হয়। প্রতিদিন দেড় থেকে দুইশ অসহায় মানুষ একবেলা পেটপুরে খাবার পান এখানে। এ জন্য প্রতি রাতে ৪০-৫০ কেজি চাল রান্না করতে হয়। সঙ্গে থাকে ডাল ও সবজি। এ ছাড়া তালিকায় থাকে মাছ, মাংস, ডিম, খিচুড়ি। মাসের প্রথম বুধবার উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়। হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে তারা মেহমান ও মুসাফির।
১৯১১ সালে দরিদ্র মানুষদের মধ্যে প্রথম খাবার বিতরণ শুরু করেন হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা মালিক মরহুম আকবর আলী মিঞা। তিনি এই অনন্য কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। এ ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন তার ছেলেরাও।
আরও জানা গেছে, আলহাজ আকবর আলী মিঞা ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগ্য অন্বেষণে সপরিবারে বাংলাদেশের পাকশি, সান্তাহার এবং পরে বগুড়ায় আসেন। স্বাধীনচেতা আকবর আলী ভাইয়ের সঙ্গে মেকানিকের কাজ শুরু করেন। ওই সময় বগুড়া শহরে মুসলমানদের খাবারের কোনো হোটেল ছিল না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হোটেলে আবার মুসলিমরা খুব একটা যেত না। আবার সনাতন লোকজন হোটেলের আসবাবপত্র মুসলিমদের ছুঁতেও দিত না। তখন থেকেই তিনি হোটেল করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন; কিন্তু হোটেল করার মতো প্রয়োজনীয় অর্থ তার কাছে ছিল না। এ জন্য নিজে মিষ্টি তৈরি করে ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। সেই পুঁজি নিয়ে ১৯১১ সালে শহরের চকযাদু রোডে মাসিক ৮ টাকা ভাড়ায় একটি হোটেল চালু করেন। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু। খুব দ্রুত আশেপাশের জেলায় তার হোটেলের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে। পরে (বর্তমান) থানা রোডে হোটেলটি স্থানান্তর করেন, যা বর্তমানে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল নামে পরিচিতি পায়।
চল্লিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত তিনি হোটেলে মাসিক ১৫-২০ টাকার মধ্যে তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন। ব্রিটিশ আমলে শহরে বিদ্যুৎ না থাকলেও তিনি নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব কারণে হোটেলটির নাম ডাক দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায় দিন দিন ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। ধর্মভীরু আকবর আলী ব্যবসায় উন্নতি ও প্রসারে সৃষ্টিকর্তার রহমত আছে এ কথা বিশ্বাস করতেন। এ বিশ্বাস থেকেই তিনি আয়ের একটা অংশ প্রতি রাতে ফকির-মিসকিনদের খাওয়াতেন। ১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগে ছেলেদের হোটেলের আয় থেকে গরিব-দুঃখিদের খাওয়ানোর নির্দেশ দিয়ে যান। সেই দায়িত্ব আজও ছেলেরা পালন করে যাচ্ছেন।
সোনাতলার খুকি বেগম শাক-সবজি বিক্রির জন্য সকালে ট্রেনে করে শহরে আসেন। রাতে যেতে না পারলে এখানে বিনামূল্যে খাবার খেয়ে স্টেশনে রাত পার করেন।
গাইবান্ধার সদরের বাসিন্দা মজিরন বেওয়া। বয়স ৬০ এর কোটা ছুঁই ছুঁই। স্বামী মারা গেছেন বছর কয়েক আগে। দুই ছেলে-মেয়ে আছে সংসারে; কিন্তু বিধবা মাকে ভাত দেন না কেউই। তাই মনে গাথা কষ্ট নিয়ে শহরে এসেছেন ভিক্ষা করতে। রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে রেলস্টেশন বা ফুটপাতে ঘুমিয়ে পড়েন।
শহরে রিকশা চালান ধুনটের বৃদ্ধ আব্দুল জোব্বার। তিনি জানান, যমুনা নদীরভাঙনে অনেক আগেই বাড়িঘর জমি হারিয়েছেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর এক ছেলে তাকে আর দেখে না। তাই সারাদিন রিকশা চালিয়ে রাতে আকবরিয়া হোটেলের খাবার খেয়ে ভাড়া করা ঝুপড়ি ঘরে ঘুমিয়ে পড়েন। এভাবেই চলছে তিন বছর।
আকবরিয়া গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) আরাফাত রহমান বলেন, রাতে যাদের খাবার দেই তারা সবাই আমাদের মেহমান। আগামীতে আরও ভালো পরিবেশে তাদের খাবার দেওয়ার চিন্তা আছে। খাবারের তালিকায় থাকে মাছ, মাংস, ডিম, খিচুড়ি।
বগুড়া লেখক চক্রের সভাপতি কবি ইসলাম রফিক বলেন, আকবরিয়া হোটেলের এই উদ্যোগ এতো ভালো লাগে যে, অনেক রাতে দাঁড়িয়ে থেকে ভাত দেওয়ার সেই দৃশ্য দেখেছি। এক মুঠো ভাত পেয়ে সব হারানো মানুষদের মুখে আনন্দের ছটা আপ্লুত করে।
মরহুম আকবর আলী মিঞার ছোট ছেলে ও আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ হাসান আলী আলাল জানান, বাবার নিয়ম পালন করে যাচ্ছেন তিনি। মূলত খাবারটি বিতরণ শুরু হয়েছিল মুসাফিরদের জন্য।
বগুড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র প্রবীণ রাজনীতিবিদ অ্যাডভোকেট এ কে এম মাহবুবুর রহমান বলেন, হাজী আকবর মিয়া খুব ভালো মানুষ ছিলেন। অভুক্ত মানুষদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া মহৎ কাজ। যে কাজটি তিনি জীবদ্দশায় করে গেছেন এবং এখন করছেন তার ছেলেরা। এটি সমাজে দৃষ্টান্ত। তাদের এই উদ্যোগ দেখে বিত্তবানরা এগিয়ে এলে সমাজ অনেক উপকৃত হবে।
মন্তব্য করুন