সনাতনী সম্প্রদায় সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। জন্মভূমি সব থেকে বেশি প্রিয়, পৃথিবীর সব সনাতনী এটি বিশ্বাস করেন। যারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, বাড়িঘরে হামলা করেছে তারা দুর্বৃত্ত। কোনো মসজিদের ইমাম কিংবা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এ হামলা চালাননি। যারা হামলা চালিয়েছে তারা অপরাধী। তাদের বিচার করতে হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহী কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মিলনায়তনে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ আয়োজিত বিভাগীয় প্রতিনিধি সভায় অংশ নিয়ে তৃণমূলের প্রতিনিধিরা এসব কথা তুলে ধরেন।
নেতারা বলেন, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাজশাহী মহানগর এলাকা ও বিভাগের বেশ কিছু জেলা-উপজেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সেদিক থেকে সেনাবাহিনী সনাতনীদের পরম বন্ধু। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমান সময় পর্যন্ত সনাতনীদের যেভাবে সাপোর্ট দিচ্ছে তা অকল্পনীয়।
সভায় তৃণমূল পর্যায়ের সনাতন নেতারা তাদের বর্তমান পরিস্থিতির কথা তুলে ধরেন। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও পৌর এলাকায় কীভাবে হিন্দুদের ওপর হামলা, নির্যাতন হয়েছে তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এ সময় নেতারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ-লুটপাটের ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে এ সংক্রান্ত জটিলতার সুরাহা চান তারা।
অনুষ্ঠানে ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন মন্দির এবং হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলাসহ নির্যাতনের কথা তুলে উপজেলার প্রতিনিধিরা বলেন, পূজা উদ্যাপন পরিষদ মানেই অনেকে ভেবে থাকেন আওয়ামী লীগ। এটি ভেবেই তারা আমাদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা চালিয়েছে। তবে সেটি ঠিক না। আমাদের পরিচয় সনাতনী। এর বাইরে এই কমিটির কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই।
পূজা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর প্রতিটি হামলার নথি সংগ্রহ করেন। নিকটস্থ থানায় যান, সেখানে মামলা নিতে অপারগতা প্রকাশ করলে আদালতে যান। সেখানেও যদি মামলা না নেয়, আর্মি ক্যাম্পে যান, সেখানে আপনার কথা বলেন। তারপর সেখানেও যদি প্রতিকার না পান কেন্দ্রে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা সব ব্যবস্থা করব। এরই মধ্যে আমরা কয়েকটি স্থানে এভাবে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সহযোগিতা করতে পেরেছি।
তারা বলেন, বর্তমানে সারা দেশের চিত্রই ভয়াবহ। একটা সময় ছিল, যখন রাষ্ট্র ছিল সাম্প্রদায়িক মানুষ অসাম্প্রদায়িক। এখন হয়েছে তার উল্টো। মুক্তিযুদ্ধের সময় কারও বাড়িতে হামলা হলে পাশের বাড়ির লোক আশ্রয় দিত। এখন পাশের বাড়ির লোকই আগুন দেয়। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়বে। সেগুলো অন্যরা দখল করে নেবে। আমাদের ছোটবেলায় উৎসবে ভেদাভেদ ছিল না। এখন বাড়িতে বাড়িতে এবং পাঠ্য বইয়ে সাম্প্রদায়িকতা চর্চা হয়। এগুলোয় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এ ছাড়া যে কোনো দুর্যোগে সবাইকে একতাবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান তারা।
তৃণমূলের প্রতিনিধিরা বলেন, পূজা উদযাপন পরিষদ একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। সনাতনীদের অধিকার আদায়ে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজ দেশে হিন্দুদের যে বেহাল দশা, এজন্য দায়ী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি। যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল করবেন তারা পূজা উদযাপন কমিটিতে আসবেন না। আপনারা যারা প্রবীণ আছেন, পরবর্তী নেতা তৈরি করেন। তরুণদের সুযোগ দেন। এতে সংগঠন আরও শক্তিশালী হবে। আমি চাই দেশের প্রতিটি থানা-উপজেলায় পূজা উদযাপন কমিটি শক্তিশালী হোক।
রাজশাহী জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অম্বর সরকারের সভাপতিত্বে ও রাজশাহী মহানগর কমিটির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট শরৎ চন্দ্র সরকারের সঞ্চালনায় সভায় অতিথি ছিলেন সাবেক সিনিয়র সচিব অশোক মাধব রায়, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোপাল দেবনাথ, পদ্মাবতী দেবী, সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর হালদার, দীপক পাল, সহ-প্রচার সম্পাদক অনয় মুখার্জি, সদস্য লক্ষ্মণ কুমার রায় প্রমুখ। সভায় অংশ নেন রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলার ৬৭টি উপজেলা ও ৫৯টি পৌরসভার দেড় শতাধিক প্রতিনিধি।
সভায় ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে নিজেদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং নানা অনভিপ্রেত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে নওগাঁর মান্দা, মহাদেবপুরসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার প্রতিনিধিরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা সনাতনীদের প্রতি মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা না থাকলে ৫ আগস্টের পর কাউকে রক্ষা করতে পারতাম না।
পূজা উদযাপন পরিষদের রাজশাহী বিভাগের তৃণমূলের প্রতিনিধিরা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাদের এলাকার বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের আন্তরিকতায় হিন্দুদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা পেয়েছে। পাবনা, নাটোরের বাগাতিপাড়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় বিএনপির কিছু নেতা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তারা আমাদের বিভিন্ন পূজা অর্চনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে মাঠে থেকে সহযোগিতা করেছেন। এতে করে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাদের প্রতি আমরা আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সভার শুরুতে মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।
মন্তব্য করুন