ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:১১ পিএম
আপডেট : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:১২ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

বাবুর্চি মুছা চাঁদাবাজি করেন বছরে ৪০ কোটি টাকা

শ্রমিক নেতা মো. মুছা। ছবি : সংগৃহীত
শ্রমিক নেতা মো. মুছা। ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যেন চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য। দীর্ঘ ১৫ বছর চাঁদাবাজি করে শ্রমিক নেতা, এক সময়ের বাবুর্চি মুছা এখন শতকোটি টাকার মালিক। তার চাঁদাবাজির ফিরিস্তি অনেক দীর্ঘ। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাস টার্মিনাল থেকে শুরু করে কক্সবাজার পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে চলে তার চাঁদাবাজি।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বহর্দ্দার হাট বাস টার্মিনালের সকল ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে দৈনিক ৪০ হাজার টাকা, কমিউনিটি পুলিশ বাবদ দৈনিক ১০ টাকা, যৌথ কমিটির নামে বাস প্রতি দৈনিক ৩০ টাকা, সিডিএ এর ইজারা বাবদ বাস প্রতি দৈনিক ৫০ টাকা, চেকার এর নামে বাস প্রতি ১০ টাকা, আরকান সড়ক শ্রমিক ইউনিয়ন এর নামে দৈনিক ৫০ টাকা, ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী বাস থেকে শ্রমিক চাঁদা ২০০ টাকা (দৈনিক ২০০ বাস চলাচল করে), দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামগামী পিকনিকের প্রতিটি বাস থেকে শ্রমিক চাঁদা ৫০০ টাকা (দৈনিক ১০০ বাস চলাচল করে)।

এছাড়াও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে নিয়মিত চলাচলকারী শ্যামলী গ্লোবাল, হানিফ গ্লোবাল, শাহ আমিন, শ্যামলী স্পেশাল, শ্যামলী পরিবহন, হানিফ দ্রুত যান, হানিফ প্লাস, পূরবী পূর্বাণী, ঈগল স্পেশাল, ঈগল প্লাস, ঈগল ফাস্ট, এস আর, নাবিল, এলায়ন, হানিফ স্টার, আনোযারা পরিবহন, বাশঁখালি, পটিয়া পরিবহন, বরকল পরিবহনগুলোর শ্রমিক ও গাড়ির মালিককে দৈনিক ও মাসিক হারে চাঁদা দিতে হয়। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ বাস চলাচল করে। তবে এস আলম, সৌদিয়া, পুরবী, মারশা পরিবহন শ্রমিকদের কোন চাঁদা দিতে হয় না।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পরিবহনকে ঘিরে দৈনিক ও মাসিক সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বাস টার্মিনাল, নতুন ব্রিজ, পটিয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া ও কক্সবাজার পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশনে চলছে এই চাঁদাবাজি। আর এদের নিয়ন্ত্রণ করছে শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ মুছা। তিনি নিজেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন।

তার চাঁদাবাজির টাকা সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শাহজাহান খান থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকা বিভিন্ন মহলে পৌঁছানো হতো বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহল। বাকি টাকা মোহাম্মদ মুছার পকেটের।

জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর ১ মাস চাঁদা নেওয়া বন্ধ ছিল। পরে মোহাম্মদ মুছা তার বাহিনী নিয়ে নতুন ব্রিজ এলাকায় নতুন করে বাস পরিবহনে চাঁদাবাজি করতে গেলে বাস শ্রমিকরা তাকেসহ তার বাহিনীকে গণধোলাই দিতে থাকে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী গিয়ে মুছা ও তার সহযোগীদের উদ্ধার করে। সম্প্রতি আবার কোনো এক অদৃশ্য শক্তির সহায়তায় তার চাঁদাবাজি চলছে পুরোদমে। তার বাহিনীর কাছে অসহায় পরিবহন শ্রমিক। যার কারণে ঘামে ভেজা শ্রমের টাকা থেকে তাদের চাঁদা দিতে হচ্ছে।

শ্রমিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, দক্ষিণ চট্টগ্রামে চলাচলকারী বাস শ্রমিকদের সংগঠন আরকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন। আমাদের বিভিন্ন দাবি আদায়ে এই সংগঠন কাজ করে আসত। প্রতি ৩ বছর অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচিত হতো। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্দেশ মতে আমরা নির্দিষ্ট চাঁদা দিয়ে আসতাম। কিন্তু বিগত ১৫ বছর ধরে কোনো নির্বাচনতো দূরের কথা দক্ষিণ চট্টগ্রামে চলাচলরত সকল ধরনের পরিবহন শ্রমিকের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো মাসিক ও দৈনিক হারে চাঁদা নিচ্ছে মুছা বাহিনী। নতুন গাড়ি রাস্তায় চলাচল করতে গেলেও তাকে এককালীন ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়। আবার দৈনিক গাড়ি প্রতি ৪০০ টাকা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রামের চাঁন্দগাও থানার মোহরা গ্রামের মৃত মোহাম্মদ ইউসুপের সন্তান মোহাম্মদ মুছা। একসময় সে আরকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসের বাবুর্চি ছিলেন। পরে ২০০৫ সালে শ্রমিকদের গ্রুপিংয়ের সুযোগে এক গ্রুপের সাথে আঁতাত করে নিজে সাধারণ সম্পাদক বনে যায়। তবে পরের বছর সেনাবাহিনীর সরকার ক্ষমতায় আসার পর তেমন সুবিধা করতে পারেনি।

তবে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। বড় বড় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে টাকার বিনিময়ে হাত মিলিয়ে শ্রমিক, মালিক থেকে শুরু করে সর্বত্র চাঁদাবাজির মহোৎসব শুরু করে। একসময় বেড়ার ঘরে তার বসবাস থাকলেও বিগত ১৫ বছরের চাঁদাবাজির টাকায় সে এখন শতকোটি টাকার মালিক। তার টাকায় নামে বেনামে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলছে শতাধিক বাস। তার গ্রামে কিনেছে কয়েক কোটি টাকার জমি। চট্টগ্রামের কাপাসগোলায় রয়েছে কয়েকটি ফ্ল্যাট। একাধিক ফিশিং ট্রলার রয়েছে। স্বর্ণের দোকানেও তার শেয়ার রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রইসুল আলম। একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মুন্সি মিয়া নামের এক ব্যক্তি। মুন্সি মিয়া মারা যাবার পর ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হন মুছা।

এ বিষয়ে ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রইসুল আলমের ছেলে মোবারক হোসেন বলেন, আমার বাবা রইসুল আলম ও মুন্সি মিয়া দুজনে চট্টগ্রামের বাদুরতলায় শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসে থাকতেন। মোহাম্মদ মুছা ওই অফিসের বাবুর্চি ছিলেন। কিন্তু মুন্সি মিয়াকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন মোহাম্মদ মুছা। এর পর থেকেই ক্ষমতা দখল করে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন মুছা।

মুছার চাঁদাবাজির বিষয়ে শাহ আমিন বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও শাহ আমিন গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমদ নবী চৌধুরী বলেন, ঢাকা থেকে দৈনিক সাড়ে ৩০০ গাড়ি কক্সবাজার-টেকনাফ পর্যন্ত চলাচল করে। তন্মধ্যে ২ তলা বাস গাড়িগুলো সড়কে চলাচলের সরকারি কোনো অনুমোদন নেই। মুছা বাহিনী ওসব গাড়ি থেকে চট্টগ্রাম, লোহাগাড়া, চকরিয়া ও কক্সবাজারে প্রতি স্টেশনে ৩০০ টাকা করে চাঁদা নেয়।

এ সময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পরিবহন জগত থেকে এ সমস্ত অরাজকতা ও চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে এবং ঢাকার গাড়ি চুক্তি মোতাবেক না চললে চট্টগ্রামের পরিবহন ব্যবসায়ীরা দেউলিয়া হয়ে যাবে।

আরকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি নুরুল কবির বলেন, ৫ আগস্টের পরে সাধারণ শ্রমিকরা চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে এবং ১ মাস চাঁদা নেওয়া বন্ধ থাকে। মুছার নেতৃত্বে বর্তমানে আবারও বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। তিনি এসব বন্ধের জোর দাবি জানান।

অভিযোগের বিষয়ে মোহাম্মদ মুছা কালবেলাকে বলেন, আমি শ্রমিকদের ভোটে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছি। আমাকে অসম্মান করার জন্য একটি পক্ষ এসব মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাংলাদেশের সেমির পথ—কতটা কঠিন, কতটা বাস্তব?

জাতীয়তাবাদী ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের একুশে ফেব্রুয়ারি পালন

খুবিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত

সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই : রাশেদ প্রধান

অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার

সীমান্ত নিয়ে বৈঠকে একমত হলো না বিজিবি-বিএসএফ

নগদ অর্থ উত্তোলন ও পরিবহনে ‘মানি এসকর্ট’ সেবা দেবে ডিএমপি

জামায়াতের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

সড়ক দুর্ঘটনার কবলে সৌরভ গাঙ্গুলি

প্রিন্স অব কলকাতার চরিত্রে রাজকুমার

১০

নরসিংদীতে বাসচাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

১১

সাধারণ শিক্ষার্থীরা শিবিরের বিপক্ষে কথা বলতে ভীত-সন্ত্রস্ত : ছাত্রদল

১২

নোবিপ্রবিতে যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত

১৩

সিটি ব্যাংকে নিয়োগ, নেই কোনো বয়সসীমা

১৪

সেই সানজিদার প্রশংসা করলেন জামায়াত আমির

১৫

ভাষাশহীদ সালাম নগরে সর্বস্তরের মানুষের ঢল

১৬

ছাত্র আন্দোলনে নিহত শিক্ষার্থীর স্মরণে বইমেলা

১৭

এখনো মাথায় ৯টি গুলি বয়ে বেড়াচ্ছেন আলাউদ্দিন

১৮

বিমানবন্দর থেকে ৪৫ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

১৯

ভোটকেন্দ্র নির্মাণের টাকা ‘প্রধান শিক্ষকের পকেটে’

২০
X