ধান চাষে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গার কৃষকরা চরম দুরবস্থার সম্মুখীন। সার, বীজ, ডিজেল, কীটনাশক, সেচসহ কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি উৎপাদনের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জমি চাষ ও সেচ ব্যয় বেড়ে গেছে।
এতে ধান চাষে সরাসরি প্রভাব পড়ছে। উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে এনে কৃষি খাত টিকিয়ে রাখতে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, মাটিরাঙ্গায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩১ টাকা দরে ৫০ টন বোরো ধান সংগ্রহ করা হয়। একই সঙ্গে আমন ধান সংগ্রহ করা হয় ৬০ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতি কেজি ৩২ টাকা দরে বোরো ধান সংগ্রহ হয় ৬৯ টন। আমন ধান সংগ্রহ হয় ৫১ টন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতি কেজি আমন ধান ৩৩ টাকা দরে সংগ্রহের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ১৫ টন।
এ বছর সরকারিভাবে ধান সংগ্রহে কৃষকের অনাগ্রহ লক্ষ করা গেছে। প্রতি কেজি ধান মানভেদে স্থানীয় বাজারে ৩৪-৩৫ টাকা করে বিক্রি করছেন কৃষক। এতে কৃষকের ভোগান্তি নেই। মাড়াই করার সঙ্গে সঙ্গে নগদ টাকায় ধান বিক্রি করতে পারছেন তারা।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাটিরাঙ্গায় প্রতি কেজি বোরো ধানের উৎপাদন খরচ প্রায় ২৪ টাকা। এক ফসলি জমিতে খরচ আরও বেশি হতে পারে। ১ কেজি ধান উৎপাদনে খরা মৌসুমে মোট ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। বেলে দোআঁশ মাটিতে পানি বেশি লাগে। এঁটেল মাটি হলে পানি পরিমাণে কম লাগে। পানি খরা বা বাষ্প হয়ে নষ্ট না হলে ১ কেজি ধান উৎপাদন করতে ৫৫০-৬৫০ লিটার পানির প্রয়োজন হয়।
বোরো মৌসুম পুরোটাই পানিনির্ভর হলেও ফলন বেশি হয়। আমনের মৌসুমে পানি লাগে না, তখন বৃষ্টির সিজন হওয়ায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি পাওয়া যায়। ফলনও ভালো হয়, খরচ হয় কম। আউশে খরচ লাগে, তবে বোরোর তুলনায় কম। তা ছাড়া প্রতি বিঘা জমিতে কৃষকের ৬ হাজার টাকার সার ও কীটনাশক খরচ হয়। বিশাল উৎপাদন খরচের চাপে জমি বর্গা করে লাভের মুখ দেখেন না কৃষক।
মাটিরাঙ্গা প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদ হওয়ার দরুন ভূগর্ভস্থ ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট মাটির নিচে পানির লেয়ার পাওয়া যায়। তাই এ স্থানে জমিতে পানির খরচও বেশি। মাটিরাঙ্গায় ছোট ছোট চড়া বা খাল থাকায় তৎসংলগ্ন এলাকায় কৃষিজমিতে ওইসব উৎস থেকে পানি সেচ দেওয়ার সুবিধা রয়েছে। যদিও উত্তোলন খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে।
এদিকে মাটিরাঙ্গায় প্রতি কানি জমিতে ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকার পানি সেচ দিতে হয়। একই সঙ্গে ট্রাক্টর দিয়ে প্রতি কানি জমি চাষের জন্য ৩ হাজার টাকা গুনতে হয় কৃষককে।
কৃষকের উৎপাদন খরচ কমাতে জৈব সার ব্যবহারের প্রতি জোর দিতে হবে জানিয়ে মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সবুজ আলী বলেন, মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসের উদ্যোগে ভার্মি কম্পোস্ট ও ট্রাইকো কম্পোস্ট জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। মাটিরাঙ্গায় এসব জৈবপ্রযুক্তির সার ব্যবহার চলমান রয়েছে। যদিও মাটিরাঙ্গার কৃষকরা জৈব সার ব্যবহার করেন কম।
আমতলীর কৃষক নুর আলম বলেন, আগে মজুরি প্রতি জন ৫০০ টাকা ছিল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমিকের দামও বাড়ছে। এখন ধান কাটা মজুরি ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। বাপ-দাদারা কৃষিকাজ করত। তাই লেগে আছি। পেশায় মায়া জমে আছে বিধায় ছেড়ে যেতে পারি না। এভাবে চলতে থাকলে একসময় শখের কৃষি ছেড়ে দিতে হবে।
চরপাড়ার কৃষক আব্দুর রব বলেন, দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে কৃষিকাজ করছি। আগের তুলনায় এখন কৃষিকাজে খরচ বেশি, লাভ কম হয়। মাঝে মাঝে লোকসান গুনতে হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হতে হলে সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি বাড়াতে হবে। ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে এবং সরাসরি বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই কৃষকের দুর্দশা কিছুটা লাঘব হবে।
মাটিরাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. সবুজ আলী বলেন, বর্তমানে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিক, চাষ এবং সেচের খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা আর্থিক সংকটে পড়েছেন।
তিনি বলেন, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং কৃষি খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা ছাড়া কৃষকদের সচেতনতা এবং সহযোগিতা বেশি প্রয়োজন, যাতে তারা নতুন প্রযুক্তি ও কৃষি কৌশলগুলো গ্রহণ করে তাদের উৎপাদন খরচ কমাতে পারেন।
মন্তব্য করুন