মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে পদ্মা ভাঙনকবলিত ৯টি ইউনিয়নে গত এক বছরে প্রায় এক হাজার বিঘার অধিক ফসলি জমিসহ বসত ভিটেবাড়ি বিলীন হয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিসের এক প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। ভাঙনরোধে টেকসই বেড়িবাঁধের দাবি জানান দুর্গম চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের।
জানা যায়, প্রায় পঞ্চাশ দশক থেকে অনবদ্য পদ্মার ভাঙনে এ উপজেলার আজিমনগর, সুতালড়ী ও লেছড়াগঞ্জে তিনটি ইউনিয়ন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নব্বই দশকের শেষ দিকে চর জেগে উঠলে তিনটি ইউনিয়নে আবার স্থায়ীভাবে জনবসতি শুরু হয়। এতে করে রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে ওঠে। বর্তমানে চরাঞ্চলের তিনটি ইউনিয়নে প্রায় ৫০ হাজারেরও অধিক মানুষের বসবাস। কৃষিনির্ভর চরাঞ্চল খাদ্যশস্য উৎপাদন ও চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এখনো ভাঙাগড়ার আতংকের মধ্য দিয়ে বসবাস করছেন চরাঞ্চলের জনগণ।
সরেজমিনে জানা যায়, গত বর্ষা মৌসুমে উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকার আজিমনগর ইউনিয়নের হাতিঘাটা এলাকা থেকে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের সেলিমপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। এতে ফসলি জমিসহ বসতভিটা ও বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়। এ ছাড়াও উপজেলার কাঞ্চনপুর, গোপীনাথপুর, রামকৃষ্ণপুর, বয়ড়া, হারুকান্দি ও ধূলশুড়া এলাকায়ও ফসলি জমি, বসতভিটা, গাছপালাসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়ে যায়।
বর্ষা মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ে লেছড়াগঞ্জের নটাখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছয় রুম বিশিষ্ট কোটি টাকার একতলা ভবনসহ ফসলি জমি পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন আতংকে বিপদগ্রস্ত চরাঞ্চলে বসবাসকারী কয়েক হাজার মানুষ।
লেছড়াগঞ্জের হরিহরদিয়া গ্রামের শেখ জামাল বলেন, গত বর্ষায় আমার ৫২ শতকের প্রায় ৫০ বিঘা জমি নদীতে গেছে। সঙ্গে ভিটেবাড়িও। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ না করলে এখন যা আছে তাও থাকবে না।
একই গ্রামের শেখ মনোরদ্দিন বলেন, ৪০ বছর আগে থেকে বসত বাড়ি ভাঙছে। গত বর্ষায়ও আমার ২০ বিঘা জমি পদ্মায় গেছে। তাতে বসতবাড়িসহ সর্বমোট আমার প্রায় ৫০ বিঘার অধিক জমি পদ্মায় চলে গেছে। প্রতি বছর যেভাবে ভাঙছে তাতে এখন যেখানে আছি এ জায়গাও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই স্থায়ী বাঁধের ব্যবস্থা না হলে সামনের বর্ষায় আমরা আর এখানে থাকতে পারব না।
লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের ৪ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মোতালেব হোসেন জানান, গত বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানির তীব্র স্রোতে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় ৬ কিলোমিটার এরিয়া নিয়ে চরাঞ্চলের ফসলি জমি নদীতে চলে যাচ্ছে। চলতি বর্ষায় প্রায় ১ কিলোমিটারের অধিক প্রস্থ এলাকা নিয়ে জমিজমা নদীতে চলে গেছে। আমার ওয়ার্ডের অনেকের বসতবাড়ি ও একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীতে চলে গেছে। শতশত কৃষক জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এ ছাড়াও এ ইউনিয়নের ১ নং ও ২ নং ওয়ার্ড সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তাই এই চরাঞ্চল রক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে স্থায়ী ভাঙনরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পুরো চরই হয়তো আবার নদীতে পরিণত হবে।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি আজিমনগর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হান্নান মৃধা জানান, ২০০৪ সালে আমি এই হাতিঘাটা এলাকায় শুয়াখাড়া গুচ্ছ গ্রাম করে দিয়েছিলাম। গত বর্ষায় সে গুচ্ছ গ্রামটি বিলীন হয়ে গেছে। গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দারা খোলা জায়গায় ঝুপড়ি ঘর তুলে বসবাস করছেন। চরাঞ্চলে শতশত বিঘা ফসলি জমিসহ বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। প্রতি বছরই ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান খান জানান, হরিরামপুরে নদীভাঙনের ফলে বছরের পর বছর কৃষি জমিসহ ভিটেবাড়ি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চরাঞ্চলে বসবাসের উপযোগী হওয়ার পর থেকেই এ অঞ্চলের বাসিন্দারা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কালের পরিক্রমায় চরাঞ্চলে পর্যাপ্ত কৃষি পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, যা দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি করে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। তাই নদীভাঙন রোধ করতে না পারলে এ অঞ্চলের কৃষি জমি বিলীন অব্যাহত থাকবে এবং অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান জানান, বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙন এলাকায় অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান সমূহে আপদকালীন কাজ হিসেবে বালি ভর্তি জিও ব্যাগের মাধ্যমে প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে মানিকগঞ্জ জেলায় নদী ভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী প্রতিরক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণের লক্ষ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি চলমান ও কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। নতুন প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহ ও বর্তমানে চলমান কার্যক্রম নিয়ে জেলা পর্যায়ে সম্প্রতি একটি গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা সব পর্যায়ের গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও জনসাধারণ ও নদী ভাঙন এলাকার ভুক্তভোগীদের কথা শুনেছি। সবার মতামত ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। চলমান কাজ সমাপ্ত ও প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহ অনুমোদিত হলে নদী ভাঙনের হাত থেকে মানিকগঞ্জ জেলা নদীর পাড়ের মানুষজন রক্ষা পাবে।
মন্তব্য করুন