নওগাঁয় একের পর এক গ্রাহকদের জমা করা কোটি কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন বিভিন্ন এনজিওর মালিকরা। সংশ্লিষ্টদের কঠোর পদক্ষেপের অভাবে দিন দিন পালিয়ে যাওয়ার এ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত নভেম্বরে গ্রাহকদের প্রায় ৬০০ কোটি নিয়ে পালিয়েছে নওগাঁর বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশনের এমডি নাজিম উদ্দিন তনু। সে টাকা নিয়ে লাপাত্তার ঘটনায় টাকা ফেরতের দাবিতে দফায় দফায় প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছেন ভুক্তভোগী গ্রাহকরা।
জেলার মান্দা উপজেলার দক্ষিণ মইনুম গ্রামের জাহানারা বেগম ভিক্ষা করে সংসার চালায়। ৫ বছর আগে মায়ের বাড়ি থেকে পাওয়া এক কাঠা জমি বিক্রি করে আড়াই লাখ টাকা বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশনের কাছে জমা রেখেছিলেন মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু হঠাৎ করে তার স্বপ্ন যেন ভেঙে চুরমার করে টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশনের এমডি নাজিম উদ্দিন তনু। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাহানারা বলছিলেন তার কথা।
তারই মতো ধানের চাতালের শ্রমিক মাসুদা। স্বামী মারা গেছে বহুদিন আগে। শেষ অবলম্বন ছেলেও রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। পরে তিনি ধানের চাতাল এবং মানুষের বাড়িতে কাজ করে অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশনের কাছে।
রানীনগর উপজেলার বেদগাড়ী ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা জনাব। তিনি তার দুই ছেলেকে দেশের বাহিরে পাঠিয়েছেন প্রায় ১০ বছর আগে। দুই ছেলের পাঠানো প্রায় ৬০ লাখ টাকা ৪ মাস আগে সমিতিতে রেখেছিলেন। হঠাৎ পালিয়ে যাওয়ায় টাকার শোকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায় তাকে। কি জবাব দিবে তার দুই ছেলেকে। এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য নাওয়া-খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
নওগাঁর সদর উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামে স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়িতে বসবাস করেন নিঃসন্তান জাহানারা বেগম (৬০)। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া পাঁচ শতক জমি বিক্রি করে দুই লাখ টাকা পেয়েছিলেন। বেশি লাভের আশায় সেই টাকা একটি সমিতিতে রেখেছিলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর টাকার লভ্যাংশ দিয়ে নিজের খরচ চালাতেন। জাহানারার সেই টাকা নিয়ে পালিয়েছে সমিতি।
জাহানারা বেগম বলেন, ‘পাঁচ মাস থেকে আর লাভের টাকা দিচ্ছে না। মূল টাকাও দিচ্ছে না। এখন তো অফিসই বন্ধ। অফিসের সবাই পালিয়ে গেছে। একটু ভালো থাকার আশায় সহায়-সম্বল সব সমিতিতে রেখে নিঃস্ব হয়ে গেছি। মানুষের বাড়িতে কাজ করে এখন কোনো রকম খেয়ে পরে বেঁচে আছি।’
নওগাঁ শহরের মাস্টারপাড়া এলাকার জাহিদুল ইসলাম। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসরে যাওয়ার সময় ১৫ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকার মধ্যে ১০ লাখ টাকা বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে প্রতি লাখে দুই হাজার টাকা লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় মাসিক আমানত প্রকল্পে জমা রাখেন।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার আগে এলাকার অনেকেই বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনে টাকা জমা রেখেছিলেন। তাদের কাছে জানতে পারি, সেখানে টাকা রাখলে লাখে ২ হাজার টাকা লাভ পাওয়া যায়। এটা শুনে সরল বিশ্বাসে পেনশনের ১০ লাখ টাকা আমানত রাখি। শুরুতে লাভের টাকা নিয়মিত দিচ্ছিল। পরে গড়িমসি শুরু করে। এক মাস দিলে আরেক মাস দেয় না- এ রকম অবস্থা। জুলাই থেকে একেবারে বন্ধ করে দেয়। এখন টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে চিন্তায় আছি।’
নওগাঁ সদর ও আশপাশের এলাকার এরকম পাঁচ হাজার গ্রাহকের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা বন্ধু মিতালি ফাউন্ডেশনের এমডি নাজিম উদ্দিন তনুসহ অন্য কর্ণধাররা।
প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রীয় তফসিলভুক্ত ব্যাংক ও সংস্থার চেয়ে বেশি মুনাফা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ব্যাংকের আদলে মাসিক ও বার্ষিক আমানত প্রকল্প, স্থায়ী বিনিয়োগ ও স্থায়ী আমানতের বিপরীতে গত দেড় দশকে এই টাকা তুলে নেয়। কিন্তু এখন লাভ তো দূরের কথা আসল টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন চালু করেছিলেন নাজিম উদ্দিন ওরফে তনু নামের এক ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠানটি চালুর আগে তিনি ঢাকায় এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি করতেন। চাকরির অভিজ্ঞতা দিয়ে বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছিলেন। নওগাঁ শহরের খাস-নওগাঁ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় করা হয়। এ ছাড়া শহরের সরিষাহাটির মোড়, বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডসহ জেলার বিভিন্ন এলাকা এবং পাশের জয়পুরহাট, রাজশাহী ও বগুড়ায় প্রতিষ্ঠানটির মোট ৭৫টি কার্যালয় ছিল। গত ১২ নভেম্বর থেকে সব কার্যালয় বন্ধ। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদপ্তর ও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন ছাড়াই এত দিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।
এখন জমানো টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য থানা, ডিসি অফিস ও এসপি অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ভুক্তভোগীরা। কিন্তু কোনো প্রতিকার মিলছে না।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জুলাই থেকে গ্রাহকদের লভ্যাংশ ও মূলধনের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। তাঁরা গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ করে পালাতে পারেন, এমন আশঙ্কায় কয়েকজন গ্রাহক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে প্রশাসনের মধ্যস্থতায় মালিকপক্ষ ও গ্রাহকদের মধ্যে একাধিকবার বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ও চেয়ারম্যান ৩০ নভেম্বরের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এর আগেই ১২ নভেম্বর নির্বাহী পরিচালক নাজিম উদ্দিন তনু ও চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ পালিয়ে যান। এরপর থেকে অন্য কর্মকর্তারাও আত্মগোপনে। নির্বাহী পরিচালকের পালানোর খবর পেয়ে গ্রাহকরা থানা ও আদালতে একাধিক মামলা করেন।
এরপর পালিয়ে যাওয়া বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের ঊর্ধ্বতন ৪ ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ মামুনকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা আটক করে নওগাঁ সদর থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এর আগে মামুনুর রশিদ মামুনের স্ত্রী, ভাগনি জামাই এবং বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী (এমডি) নাজিম উদ্দিন তনুর বোন সুফাকে আটক করে পুলিশ।
জেলা সমবায় কর্মকর্তা খন্দকার মনিরুল ইসলাম বলেন, বন্ধু মিতালী ফাউন্ডেশন কোনো সমিতি বা বেসরকারি সংস্থা নয়। যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিয়ে সংস্থাটি কার্যক্রম চালাচ্ছিল। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তাদের মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) সনদ ছিল না। এরপরও বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের নামে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নেন।
শুক্রবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে জানতে চাইলে নওগাঁর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পদোন্নতিপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার) গাজিউর রহমান কালবেলাকে বলেন, এ বিষয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া গ্রাহকদেরও সচেতন হতে হবে। অতি মুনাফার লোভে সরকারি অনুমোদন নেই এরকম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আর্থিক লেনদেন করা থেকে বিরত থাকতে হবে বলেও মন্তব্য করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা।
জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল কালবেলাকে জানান, গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের আইনিভাবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি গ্রাহকরা কীভাবে তাদের সঞ্চিত টাকা ফেরত পাবেন, সে বিষয়টিও ভাবা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা পেলে সেটি বাস্তবায়ন করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, নওগাঁয় প্রতি মাসে দু-একটি করে সমবায় ও ঋণদান সমিতি লাপাত্তা হবার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ৮-১০টি সমবায় ও ঋণদান সমিতি প্রায় হাজার কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে। এতে নিঃস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। তাই সঠিক তদারকির দাবি জানিয়েছেন সচেতনরা।
মন্তব্য করুন