রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হয়বত খাঁ চরের বাসিন্দা আব্দুর রশিদ। পৈতৃকসূত্রে পেয়েছিলেন ৩০০ বিঘা জমি; কিন্তু তিস্তার পেটে জমি বিলীন হয়ে যাওয়ায় তিনি এখন ঢাকায় সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন। মাঝেমধ্যে রিকশাও চালান। তিস্তা নিয়ে গণশুনানিতে আব্দুর রশিদের জীবনের এমন করুণদশা জানান তার ছেলে আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, জমিজমা-বাড়িঘর সব হারিয়ে মাকে নিয়ে তিনি এখন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। খুবই কষ্টে চলছে তাদের জীবন।
রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে কাউনিয়ার তিস্তা রেলব্রিজের নিচে ‘তিস্তা নিয়ে করণীয়’ শীর্ষক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। তিস্তাপাড়ের মানুষের দুর্দশার কথা শুনতে গণশুনানিতে উপস্থিত হন অন্তর্বর্তী সরকারের বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
গণশুনানিতে অংশ নেন তিস্তাবেষ্টিত ৫ জেলার কয়েক হাজার মানুষ। এ সময় তারা সরকারের দুই উপদেষ্টার কাছে তাদের দুর্দশার কথা জানান। উপদেষ্টাদের তারা বলেন, যুগ যুগ ধরে তিস্তায় বাড়িঘর জমিজমা হারিয়ে সরকার শুধু ত্রাণ দিয়েছে। আর ত্রাণ নয় বরং মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানান তারা।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার রাজপুরের বাসিন্দা আব্দুস সালাম উপদেষ্টাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হামার হইছে কপাল পোড়া, হামার দুঃখ কেউ বোঝে না। তিস্তার ভাঙনে রাজপুর এখন ফকিরপুর হইছে। একনা চরোত যাও, হামার বাড়িভাঙা না দেখলে হামার দুঃখ বুঝবেন না। আগের সরকার কিছু করে নাই এবার আর হামাক ঠগান না বাহে।’
গণশুনানিতে বক্তব্য দেন এই এলাকার বাসিন্দা ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুধু কল্পনাতেই; কিন্তু বাস্তবে নেই। বর্ষা মৌসুমে তিস্তাপাড়ের মানুষের বাড়ি বারবার ভেঙে যায়, তাদের কষ্ট আমরা জানি। ভারত তিস্তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মামলা করে পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নিতে হবে।
নদীপাড়ের বাসিন্দারা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনার নামে এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে বছরের পর বছর ধরে প্রতারণা করেছে। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা শুকিয়ে মরুভূমি হয়। আবার বর্ষায় পানি প্রত্যাহারে ফেঁপেফুলে উঠে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ডুবিয়ে দেয় এ জনপদ। বাঁচামরার খেলা থেকে বাঁচতে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি জানান তারা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, তিস্তার দুপাড়ের ৪৫ কিমি. ভাঙনপ্রবণ এলাকার মধ্যে অধিক পরিমাণে ভাঙনকবলিত ২০ কিলোমিটার এলাকার ভাঙনরোধের কাজ আগামী মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু করা হবে। বাকি অংশের ভাঙনরোধের কাজও পর্যায়ক্রমে শুরু করা হবে।
তিনি বলেন, ভাঙনরোধের কাজটা তদারকির জন্য একটা ওয়ার্কিং গ্রুপ করে দেব যাতে ভাঙনপ্রবণ পাঁচ জেলার প্রতি জেলা হতে একজন করে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকবে। ভাঙনপ্রবণ এলাকার ১ জন করে স্থানীয় মানুষ থাকবে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এটি করা হবে। উপদেষ্টা আরও বলেন, তিস্তাপাড়ের মানুষের মতামত নিয়েই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। আপনাদের মতামত ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড চীনের সঙ্গে মহাপরিকল্পনার কোনো চুক্তি চূড়ান্ত করবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজাইনে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আপনারা স্থানীয়রা থাকবেন। তিনি আরও বলেন, সমস্যা সমাধানের রাস্তায় যাত্রাটা আমরা শুরু করলাম। এ যাত্রাটা দ্রুতগতিতে চলবে এবং সেটা আপনাদের সঙ্গে নিয়েই চলবে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, তিস্তা চুক্তির খসড়া নিয়ে আওয়ামী লীগ ২০১১ সাল থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার ভারত থেকে কিছু আদায় করতে পারেনি। তাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলেছে। তারা তিস্তার কথা বলতে পারেনি; কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার শিরদাড়া উঁচু করে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা করবে। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের কূটনৈতিক চাপ দেওয়া হবে যাতে তারা বাধ্য হয়ে এ চুক্তি স্বাক্ষর করে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সালের সভাপতিত্বে গণশুনানিতে আরও বক্তব্য দেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব একেএম তারিকুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদ, বিএনপি নেতা এমদাদুল ভরসা, একেএম মমিনুল হক প্রমুখ।
মন্তব্য করুন