উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অবস্থায় দুর্নীতিতে জড়িয়ে তাৎক্ষণিক বদলি হয়েছিলেন। সেই দুর্নীতি নিয়ে তদন্তও হয়েছিল। পরে তাকে আবার সেই জেলায় পদায়ন দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) হিসেবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রবিধানমালা ডিঙ্গিয়ে এমন পদায়নে ক্ষোভ উঠেছে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। তবে প্রভাব খাটিয়ে নিয়ম ডিঙ্গিয়ে পদে বহাল রয়েছেন খুলনা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সাদিয়া আফরিন।
খুলনা জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠ প্রশাসন-২ শাখার এক প্রজ্ঞাপনে তাকে খুলনা সেটেলমেন্ট অফিস থেকে খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলি করা হয়। পরে ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে যোগদান করতে গেলে প্রথমে বিপত্তি বাধলেও পরে ২৯ সেপ্টেম্বর যোগদান করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাদিয়া আফরিনের এই বদলিতে মাঠ প্রশাসনের নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট হিসেবে মাঠ প্রশাসন পদায়নের একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সেখানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদায়নে কিছু নির্দেশনা উল্লেখ রয়েছে। সেই গেজেটটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাদিয়া আফরিনের পদায়নে কয়েকটি ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। গেজেটের ৩.৭.৬ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কমর্রত ছিল, তাকে একই জেলায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করা যাবে না। তবে সাদিয়া আফরিন ২০২২ সালের ১৩ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে খুলনার ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। শুধু তাই নয়, সেখানে কর্মরত অবস্থায় আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই কর্মকর্তা। ফলে তাৎক্ষণিক বদলিও হয়েছিলেন তিনি।
জানা গেছে, ফুলতলা উপজেলার দামোদর ও আলকা মৌজায় আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৭৪ লাখ ৪৭ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে ২ দশমিক ৬৬ একর জমি কেনা হয়। ওই জমিতে গৃহহীন ও ভূমিহীন ৭০টি পরিবারের আবাসনের জন্য ২ শতাংশ জমিসহ ৭০টি ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দেয় সরকার।
নকশা অনুযায়ী, এ ঘরে সাড়ে ১৯ ফুট ও ২২ ফুট ৮ ইঞ্চি সাইজের দুই রুম বিশিষ্ট মূল ঘরের সঙ্গে বারান্দা, রান্নাঘর ও টয়লেট থাকবে। এর জন্য ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা ছাড়াও মালামাল পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত ৫ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়।
এই প্রকল্পের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ইউএনও সাদিয়া আফরিন। ঘরে নিম্নমানের ইট, খোয়া ও বালু ব্যবহার হচ্ছে এমন অভিযোগের বিষয়ে ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর খুলনার তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পুলক কুমার মন্ডল সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া ১৪ নভেম্বর বিকেলে খুলনার অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. শহিদুল ইসলাম ঘরের কাজের অগ্রগতি ও নির্মাণ কাজ দেখতে যান।
পরিদর্শন শেষে তারা জানান, নির্মাণ কাজে ২ নম্বর ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রেড বিমে ১২ মিলিমিটারের পরিবর্তে ১০ মিলিমিটার রড ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া বিম ও কলামে ৮ মিলি রিং রড ৬ ইঞ্চির পরিবর্তে ১৫ ইঞ্চি পরপর ব্যবহার করা হয়েছে।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের পর ২৪ নভেম্বর ইউএনও সাদিয়া আফরিনকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে বদলির নির্দেশ দেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। তবে দায়িত্ব ছাড়ার আগের দিন ২৮ নভেম্বর তিনি অতি গোপনে তিনটি চেকের মাধ্যমে আরও ২০ লাখ ৪ হাজার ৯৯১ টাকা ঠিকাদারকে প্রদান করেন, যা নিয়ে পরবর্তীতে খুলনা জেলা প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করে।
জানা গেছে, সাদিয়া আফরিনের বাবা খুলনার একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক। সে সুবাদে তার বেড়ে ওঠা খুলনাতেই। লেখাপড়া করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। যে কারণে এই কর্মকর্তার চেষ্টা থাকে সব সময়ে খুলনাতেই পদায়ন নেওয়ার। তার জাতীয় পরিচয়পত্রের স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ঠিকানাই উল্লেখ রয়েছে, ৩/বি মেডিকেল কোয়ার্টার, ছোট বয়রা মেইন রোড, সোনাডাঙ্গা, খুলনা। তবে জন্মস্থান উল্লেখ রয়েছে ঝিনাইদহ জেলা।
তিনি ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের সময়ে নিজ স্থায়ী জেলা ঝিনাইদহ উল্লেখ করেছিলেন। এডিসি হিসেবে যোগদানের সময়েও একই জেলার নাম উল্লেখ করেছেন। তবে বিপত্তি বাধে স্বামীর স্থায়ী ঠিকানা ভিন্ন নিয়ে। তিনি ইউএনও হিসেবে যোগদানের সময় স্বামীর স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছিলেন সাতক্ষীরা জেলা ও এডিসি হিসেবে যোগদানের সময়ে স্বামীর স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছেন ঝালকাঠি জেলা। মাঠ প্রশাসন পদায়নের গেজেটের ৩.৭.৬ ধারা মতে, এডিসিদের নিজ বা তাদের স্বামী বা স্ত্রীদের জেলায় পদায়ন করা যায় না।
এ নিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাদিয়া আফরিন দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন বলে স্বামীর ঠিকানায় গরমিল হয়েছে। তবে তার দ্বিতীয় স্বামী আল আমিন ফুলতলা উপজেলা পরিষদের মালি পদে এর আগে চাকরি করেছেন। ওই পদটিতে চাকরি করতে গেলে খুলনা জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হয়।
সাদিয়ার প্রথম স্বামী আবু সাইদ আশরাফুল কামাল বলেন, উপজেলা পরিষদের মালি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া আল আমিন পরবর্তীতে সাদিয়ার গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে দায়িত্ব পান। সে সময় একে অন্যের প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। পরে ২০২৩ সালের জুন মাসে আমার ও সাদিয়ার ডিভোর্স হয়ে যায়। ওই বছর সে ওই মালিকে বিয়ে করে। এরপর থেকে তার সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আল আমিন খুলনা জেলার ফুলতলার স্থায়ী বাসিন্দা। এই জেলার বাসিন্দা হওয়ায় তার নামে আগে আশ্রয়ণের ঘরও বরাদ্দ হয়েছিল। ফলে সাদিয়া আফরিন এডিসি হিসেবে পদায়নের জন্য স্বামীর ঠিকানাও কারসাজি করেছেন বলে মনে করেন অনেকে।
খুলনা জেলা প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সরকারি নিয়ম-কানুন ভেঙে এভাবে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে সাদিয়া আফরিনের পদায়নে তারা হতবাক হয়েছেন। তারা বলছেন, দুর্নীতি করেও তিনি কীভাবে এডিসির ফিটলিস্টে আসলেন, তা বোধ্যগম্য নয়। আর দুর্নীতির তদন্তের সময়ে তার বিরুদ্ধে যে সব কর্মকর্তা সরাসরি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তারাও এখন হয়রানির ভয়ে রয়েছেন।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার বলেন, এই পদায়নে আমাদের কোনো এখতিয়ার নেই। এটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিষয়।
প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এই এডিসির বদলির দাবি তুলেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনা শাখার সভাপতি কুদরত-ই খুদা। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন হলো সব সরকারি কাজের মূল গন্তব্য। সেখানে পদায়নে এভাবে নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করা যাবে না। কেন অনিয়মের মাধ্যমে এখানে পদায়ন করা হলো, সে বিষয়টি তদন্তসহ আমরা অচিরেই তার বদলির দাবি করছি।
এ বিষয়ে জানতে দুদিন ধরে সাদিয়া আফরিনের মুঠফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি রিসিভ হয়নি। পরে তার ব্যবহৃত মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়রি) তার কার্যালয়ে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন