রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩৫ পিএম
অনলাইন সংস্করণ

সমাজসেবার সেই সানোয়ার বহাল তবিয়তে, ২ মাসেও অন্ধকারে তদন্ত প্রতিবেদন

মো. সানোয়ার হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
মো. সানোয়ার হোসেন। ছবি : সংগৃহীত

ভালো মানুষকে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া রাজশাহীর বাঘা উপজেলার সমাজসেবা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. সানোয়ার হোসেন এখনো বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। ‘প্রতিবন্ধী তৈরির কারখানা সমাজসেবা কার্যালয়’ শিরোনামে গত বছরের ৮ নভেম্বর কালবেলা ডিজিটালে সংবাদ প্রকাশের পর নড়েচড়েই বসেছিল সমাজসেবা অধিদপ্তর।

ঘটনা তদন্তে ১০ নভেম্বর রাজশাহী সমাজসেবা কার্যালয় তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল। এরপর ২৫ নভেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখা আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই তদন্ত কমিটি গত ১ ও ২ ডিসেম্বর রাজশাহীতে সরেজমিনে গিয়ে তদন্তও করে। কিন্তু প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

অভিযোগ উঠেছে, খোদ সমাজসেবা অধিদপ্তর, ঢাকার দুই-একজন কর্মকর্তার ছত্রছায়ার কারণে দুর্নীতিবাজ বাঘার এই সমাজসেবা কর্মকর্তা পার পেয়ে যাচ্ছেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) মোস্তাফা মাহমুদ সারোয়ার নিজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের কমেন্টে সানোয়ারের পক্ষ নিয়ে কথা বলার একটি স্ক্রিনশট কালবেলার হাতে এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ঘটনার সঙ্গে সানোয়ার জড়িত না, ঘটনা ঘটেছে সে (সানোয়ার) আসার আগেই। বিষয়টি সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও (ডিজি) অবগত আছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। কমেন্টে এই কর্মকর্তা সাংবাদিকদের নিয়ে মানহানিকর বক্তব্যও উপস্থাপন করেছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের জের ধরে গত ১০ নভেম্বর রাজশাহী পিএইচটি সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক (সহকারী পরিচালক) তৌহিদুজ্জামানকে আহ্ববায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়। এই কার্যালেয়ের উপপরিচালক হাসিনা মমতাজ স্বাক্ষরিত এই তদন্ত কমিটির আদেশপত্রে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে সরেজমিন তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন উপপরিচালকের নিকট পাঠাতে বলা হয়। এরপর ঢাকা থেকেও ২৫ নভেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখার উপপরিচালক (প্রতিবন্ধী ভাতা) মো. নুরুল হক মিয়া স্বাক্ষরিত আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর আলোকে গত ১ ও ২ ডিসেম্বর মো. নুরুল হক মিয়ার নেতৃত্বেই তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল রাজশাহীতে এসে সরেজমিন তদন্ত করে গেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই দুই তদন্তের কোনো প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখার উপপরিচালক (প্রতিবন্ধী ভাতা) মো. নুরুল হক মিয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি এই প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেনি। অভিযুক্ত বাঘার সমাজসেবা কর্মকর্তার পক্ষ নিয়ে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে মন্তব্য করার বিষয়ে জানতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) মোস্তাফা মাহমুদ সারোয়ারের অফিসিয়াল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।

জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) সৈয়দ মোস্তাক হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘ঢাকা থেকে যে তদন্ত হয়েছে সেটির বিষয়ে আমরা বলতে পারব না। তবে শুনেছি, তদন্ত প্রতিবেদন তারা ডিজির কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু লোকালি যে তদন্ত হয়েছে, ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সেই তদন্ত তদন্ত প্রতিবেদন ডিজি বরাবর পাঠানো হয়েছে। তবে ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত যে কর্মকর্তাই করুক না কেন বা অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী-নির্দোষ যেটাই হোক তা ফেসবুক পর্যন্ত যাওয়ার কথা নয়। ফেসবুকে এটি নিয়ে ওই কর্মকর্তার এ ধরনের কথা বলারই কথা নয়। তারপরও আমি বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে পারি।’

কালবেলার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সানোয়ার হোসেন গত বছরের ১২ অক্টোবর বাঘায় সমাজসেবা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) হিসেবে যোগদান করেন। এ সময়ের মধ্যে তার পূর্ববর্তী তিনজন কর্মকর্তার (যারা বাঘায় সমাজসেবা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন) স্বাক্ষর জাল করে তিন কিস্তিতে ‘ব্যাক ডেটে’ টাকার বিনিময়ে অধিকাংশই সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। কালবেলা অনুসন্ধান চালিয়ে এমন ৭১২টি প্রতিবন্ধী কার্ড হাতে পেয়েছে। এই কার্ডগুলোর কিছু ১৬ মার্চ ২০২১, ৭ এপ্রিল ২০২২ এবং কিছু কার্ড ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ সালের ইস্যু করা। এসব কার্ডে যখন যে কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন সংশ্লিষ্ট সেই কর্মকর্তা স্বাক্ষর রয়েছে। তবে ভিন্ন সন-তারিখে প্রতিবন্ধী এসব কার্ড ইস্যু হলেও বর্তমান কর্মকর্তা সানোয়ার হোসেনের সময়ই বিতরণ করা হয়েছে। সানোয়ার হোসেন এসব ভুয়া কার্ড ইস্যুর সঙ্গে সরাসরি জড়িত, এমন কিছু কল রেকর্ড কালবেলা প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, প্রতিবন্ধী কার্ড করে দিতে মো. রিয়াদ মোবারক নামের এক যুবককে ব্যবহার করেন সানোয়ার হোসেন। এই যুবকই সমাজসেবা কার্যালয়ের ‘প্রতিবন্ধী বানানোর আজব এই কারখানা’র গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। প্রতিবেদকের কাছে রিয়াদ অকপটে সবকিছু স্বীকারও করেছেন। মূলত এই রিয়াদকেই সমাজসেবা কর্মকর্তা সানোয়ার নাটের গুরু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। রিয়াদকে প্রথমে ‘ফাঁদ’ হিসেবে বাঘার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের কাছে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার বার্তাবাহক হিসেবে পাঠানো হতো।

রিয়াদ বিভিন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাউন্সিলদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকার গরিব-অসহায়দের টাকার বিনিময়ে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতেন। রিয়াদ সংশ্লিষ্ট মেম্বার-কাউন্সিলরদের থেকে গরিব-অসহায় মানুষদের প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ছবি ও ‘ঘুষের টাকা’ সানোয়ারকে এনে দিতেন। আর সানোয়ার ব্যাক-ডেটে সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে সর্বনিম্ন দেড় হাজার থেকে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে করে দিতেন ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ড। অনুসন্ধানে টাকার বিনিময়ে উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়নে ৪০টি, মনিগ্রাম ইউনিয়নে ২০টি, আড়ানি ইউনিয়নে ১৩০টি, আড়ানি পৌরসভা এলাকায় ১৬০টি, গড়গড়ী ইউনিয়নে ১৫২টি, বাজুবাঘা ইউনিয়নে ৪০টি, চক রাজাপুর ইউনিয়নে ১০টি এবং বাঘা পৌরসভা এলাকায় ১৬০টি প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সব মিলিয়ে ৭১২ জনকে এই প্রতিবন্ধী কার্ড দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে অন্তত ২৫ লাখ টাকা।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

প্রথম বিদেশ সফরে সৌদিকে বেছে নিল সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট

মিমির ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করলেন তারেক রহমান

সিলেটে প্রাইভেট কার-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত ৫

কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন

বাসের সিটে বসা নিয়ে শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষ

বর্ষার আগে ১৯টি খালে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

গুলি ছুড়ে ছিনতাইয়ের চেষ্টা, কালবেলার সাংবাদিকসহ আহত ২

এবি পার্টির নবগঠিত সম্পাদকীয় কমিটির অভিষেক

একনেকে ১২ হাজার ৫৩২ কোটি টাকার ১৩ প্রকল্প অনুমোদন

‘আমি আলমগীর’ নিয়ে আসছেন নায়ক আলমগীর

১০

সাবধান, সাবধান, সাবধান! / আসছে সৃজিতের ‘কিলবিল সোসাইটি’

১১

কলেজছাত্রীকে বেধড়ক পেটালেন আ.লীগ নেতা

১২

কুকুরের তাড়া খেয়ে ভ্যানচালককে পেটালেন ম্যাজিস্ট্রেট

১৩

জামায়াতকে নিষিদ্ধের চারদিন পর আ.লীগ পালিয়েছে : শাহজাহান চৌধুরী

১৪

অমর একুশসহ কোনো আয়োজনে ঢাবি শিক্ষক সমিতিকে না রাখার দাবি সাদা দ‌লের

১৫

বিসিবি থেকে পদত্যাগ করে নতুন মিশনে হান্নান সরকার

১৬

ইজতেমায় পদদলিত হয়ে ৪০ মুসল্লি আহত

১৭

তিতুমীরে অনশনরত ৩ শিক্ষার্থীর অবস্থা আশঙ্কাজনক

১৮

হারার পর রেফারির ওপর ক্ষোভ ঝাড়লেন আনচেলত্তি

১৯

‘শাশুড়ির ভয়ে’ প্রেমিককে নিয়ে গলায় ফাঁস গৃহবধূর

২০
X