দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত পাঁচ মাসে গাজীপুরে ৫২ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৪১ স্থায়ীভাবে আর ১১ কারখানা অস্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া আগামী মে থেকে কেয়া গ্রুপের আরও সাত কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার কর্মহারা অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন।
বন্ধ থাকা কারখানার এসব শ্রমিকের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়াসহ বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই বন্ধ থাকছে মহাসড়ক। এসব শ্রমিকদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ব্যাংকিং জটিলতা নিরসন করে কারখানাগুলো খুলে দেওয়ার দাবি কারখানা কর্তৃপক্ষের।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশ ও শ্রমিকরা জানায়, রাজধানীর লাগোয়া টঙ্গী ও গাজীপুর এক সময় নানা কারণে বিখ্যাত হলেও বর্তমানে শিল্পনগরী হিসেবেই পরিচিত। কর্মের কারণে গাজীপুরে সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ বসবাস করে। জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে নিবন্ধিত কারখানা রয়েছে ২ হাজার ১৭৬। এর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ১৫৪। গত নভেম্বর মাস থেকে ৩৫ তৈরি পোশাক কারখানা তাদের কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি, যা মোট কারখানার ২ শতাংশ। ডিসেম্বর মাস থেকে বেতন দেয়নি ৪৫ ভাগ কারখানা। এ মুহূর্তে গাজীপুরের ৫ শতাংশ কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ রয়েই গেছে। ৯ শতাংশ কারখানায় ইনক্রিমেন্ট নিয়ে জটিলতা চলছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনস কারখানায় ছয় বছর কাজ করেছেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার নীলিমা আক্তার। তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করেন চন্দ্রার ভাতারিয়া এলাকায়। নীলিমা আক্তার কালবেলাকে বেলন, তাদের কারখানার সব শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। পুরুষ শ্রমিক যারা ছিল, তাদের বেশিরভাগই অন্যত্র নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে। কিন্তু আমরা মধ্যবয়সী নারীরা কোথাও চাকরি পাচ্ছি না। গত এক মাসে অন্তত আটটি কারখানায় যোগাযোগ করেছি, কিন্তু নতুন চাকরি পাইনি। এখন স্বামীর একার আয় দিয়ে কোনোরকমে জীবনযাপন করছি।
একই এলাকার বাসিন্দা মো. লিয়াকত সিকদার বলেন, চাকরি হারিয়ে ঘরে বসে আছি। জমানো কিছু টাকা দিয়ে আর গ্রামের বাড়ি থেকে চাল, সবজি এনে খাচ্ছি। নতুন চাকরির সন্ধান করছি; কিন্তু বেতন খুবই কম বলছে। তাই আরও খোঁজাখুঁজি করছি।
গাজীপুর নগরের জরুন এলাকার কেয়াগ্রুপ দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। কিন্তু গত ২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক কারখানার সামনে নোটিশ টানিয়ে দেন- আগামী ১ মে থেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ ঘোষণা করার।
কেয়া গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, আগামী ১ মে থেকে ৫ এবং ২০ মে থেকে আরও দুইসহ সাত কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি ধাপে শ্রমিকদের সব পাওনা শ্রম আইন অনুযায়ী পরিশোধ করা হবে।
গত ১৫ ডিসেম্বর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বেক্সিমকোর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রম ও ব্যবসায় পরিস্থিতি পর্যালোচনা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের কমিটির সভার সিদ্ধান্তের পর বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের ১৬ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। বন্ধের কারণ হিসেবে সরকার জানায়, কারখানাগুলোয় অর্ডার না থাকা ও ব্যাংকে ঋণখেলাপি থাকায় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানকার কারখানাগুলোয় এখন ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। পড়ে আছে কোটি টাকা মূল্যের মেশিনপত্র। ওই কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন কর্ম হারানো ৪২ হাজার শ্রমিক।
বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) এসএম আব্দুল লতিফ জানান, তাদের কারখানায় ৪২ হাজার শ্রমিক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেকার হয়েছেন। শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আমরা লে-অফ তুলে নিয়ে সরকারের সহযোগিতা চাইছি। প্রধান উপদেষ্টাসহ সবার কাছে আমরা অনুরোধ করছি ব্যাক টু ব্যাক এলসি ওপেন করে সব ব্যাংকিং সুবিধাসহ লে-অফ তুলে নেওয়ার।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে, শ্রমিক বেকারত্বের সংখ্যাও বাড়ছে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পুলিশ সুপার একেএম জহিরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ব্যাংক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে কারখানাগুলো বন্ধ হচ্ছে বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। আমরা আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, কর্মহীন শ্রমিকদের অনেকেই কারখানা খুলে দেওয়া ও বকেয়া বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায়ই বন্ধ থাকছে ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক। এসব শ্রমিককে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মন্তব্য করুন