রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৫:০৩ পিএম
অনলাইন সংস্করণ
বিডিআর হত্যাকাণ্ড

খালাসের পরও ১১ বছর জেল খাটেন কামরুল

সৈনিক কামরুল হাসান। ছবি : কালবেলা
সৈনিক কামরুল হাসান। ছবি : কালবেলা

সৈনিক কামরুল হাসানের সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। বিপত্তি ঘটে বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার ১৩ মাস পরে। হঠাৎ কোনো এক সন্ধ্যায় কামরুলের জুনিয়র একজন খবর নিয়ে আসে তার নামে মামলা হয়েছে। কামরুলের জন্য অপেক্ষাও করছে পুলিশ। সে দিনই ছিল কামরুলের সৈনিক জীবনের শেষ ডিউটি। সবকিছু গুটিয়ে পুলিশের সঙ্গে যান থানায়। শুরু হয় কারাবাসের বন্দি জীবন।

তবে আইনি প্রক্রিয়ায় কামরুল শেষ রক্ষা পেয়েও অবসান হচ্ছিল না বন্দি জীবনের। ২০১৩ সালে মামলা থেকে খালাস পাওয়ার পরও তাকে বিনা অপরাধে আরও ১১ বছর জেল খাটতে হয়েছে।

সম্প্রতি কামরুল মুক্তি পেয়েছেন। এরপরই রাজশাহীর পবা উপজেলায় নিজ বাড়িতে গিয়ে মুক্তি পাওয়া কামরুল ও তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কালবেলার কথা হয়। এ সময় কামরুল তার জীবনে ঘটে যাওয়া লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেন।

এ সময় কামরুল বিডিআর বিদ্রোহের সময়ে নিজের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কামরুলের পাশের সোফায় বসা তার মা-বাবাও ছেলের কষ্টের কথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকেন।

কামরুল বলেন, একদিন ডিউটি শেষে ক্লান্ত শরীরে রুমে শুয়ে আছি। হঠাৎ জুনিয়র একজন সৈনিক এসে আমাকে বলে, আপনাকে স্যার ডাকে। আমি বললাম, তুমি স্যারকে বলো আমি বাইরে ডিউটিতে গিয়েছিলাম। এটা বললে স্যার বুঝবে। আমি পরে স্যারের সঙ্গে দেখা করব। সে দুই পা পেছনে গিয়ে আবার এসে আমাকে বলে, ভাইয়া আপনি চলেন, আপনাকে স্যার ডাকে। আপনার নামে মামলা হয়েছে, পুলিশ অপেক্ষা করছে। সৈনিকের এ কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তখন দ্রুত উঠে স্যারের রুমে গেলাম। সেখানে আমার নাম, বাবার নাম, সৈনিক নম্বর মেলানোর পর আমাকে জানানো হয়- সরকারি সব পোশাক রেখে আপনার লাগেজ গুছিয়ে নিয়ে আসেন। আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। বেরিয়ে গেলাম। এরপর থেকে শরীরে আর সৈনিকের পোশাক ওঠেনি।

কামরুল হাসান বলেন, এরপর শুরু হয় দীর্ঘ কষ্টের জীবন। বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৩ সালে আমি যে মামলার আসামি সে মামলার রায় হয়। সে রায়ে আমি খালাস পাই। তখন একটাই স্বপ্ন। বাড়িতে যাব, মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরব। কতই না আবেগ কাজ করেছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু খালাস পাওয়ার পরও আমাকে জেলে থাকতে হয়েছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে।

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কামরুল বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের দিনই প্রথম দরবার হলে যাই। ছিলাম একেবারে পেছনে। সামনে স্যারদের কথাও তেমন শুনতে পাইনি। কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ বাইরের বিকট শব্দ কানে এলো। তখন সবাই দ্রুত দরবার হল ত্যাগ করতে লাগল। তখনো আমার বুঝে আসেনি যে এখানে এগুলো কী হচ্ছে। সেখান থেকে কোনো মতে বের হয়ে দেখা হয় আমার সেকশনের একজন মেজরের সঙ্গে। তার থেকে কিছু শোনার আগেই তিনি দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ঘটনা ঘটার পরও আমি বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতেই পারিনি। তারপর দ্রুত আমার সেকশনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, আমার সিনিয়ররা আছেন।

তারা আমাদের জুনিয়র সৈনিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা বাইরে যেও না। এখানে থাকো। ভয় পেয়ো না। আল্লাহকে ডাকো।’ সেখানে আতঙ্কিত অবস্থায় বসে সন্ধ্যা পার করলাম। এ সময়ের মধ্যে বাড়িতে কল দিয়ে বিষয়টা জানালাম। অথচ নিরপরাধ মানুষ আমি। খালাস পাওয়ার পরও আমাকে দীর্ঘ ১১ বছর জেলেই কাটাতে হলো।

কামরুল বলেন, জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় জেলের মধ্যে কেটেছে। সে সময়গুলো অনেক কষ্টের ছিল। সে সময়গুলো জীবনে আর ফিরে আসবে না। তবে আল্লাহকে বলতাম- আল্লাহ তুমি জানো আমার কী অপরাধ। তুমিই উত্তম ফয়সালা দিও। আল্লাহর রহমতে মুক্তি পেয়েছি। এখন আগামীর জীবন নিয়ে চিন্তায় আছি। জীবনের শেষ সময়ে এসে আমি এখন বেকার। এখন চাইলেও কোনো কাজ করতে পারব না। আমার মতো অনেক নির্দোষ, নিরপরাধ সৈনিক জেল থেকে খালাস পেয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই প্রত্যাশা, আমরা যেন আবার কর্মজীবনে ফিরে যেতে পারি।

কামরুলের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী পাটকল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন কামরুল। এরপর এইচএসসিতে ভর্তি হন আদর্শ ডিগ্রি কলেজে। সেখানে এইচএসসি পাস করে যোগ দেন তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরে (বর্তমান নাম বিজিবি) সৈনিক হিসেবে। প্রশিক্ষণ শেষে ২০০৮ সালে যোগ দেন পিলখানায় (বর্তমান বিজিবি সদর দপ্তর)। সেখানে তিনি ইলেকট্রিক মোকানিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইএমই) শাখায় কর্মরত ছিলেন। যোগদানের এক বছরের মাথায় ঘটে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা। ওই ঘটনার ১৩ মাস অতিবাহিত হওয়ার পরে তাকে হত্যা মামলায় কারাগারে যেতে হয়। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি।

কামরুলের মা সেফালী বেগম বলেন, ছেলে কারাগারে থাকায় আমিও অসুস্থ হয়ে পড়ি। ভারতে চিকিৎসা চলছিল, সেখানে আমার অপারেশনও হয়েছে। এত কথা ছেলেকে জানাইনি। ভারতের হাসপাতালে অপারেশনের আগে আল্লাহকে বলেছি- আল্লাহ আমাকে জীবন ভিক্ষা দাও। আমার ছেলেকে জেল থেকে বাড়ি ফিরে যেন না শুনতে হয় যে তার মা মারা গেছে। আল্লাহ আমার ফরিয়াদ কবুল করেছেন। আমিও সুস্থ আছি। আমার বুকের মানিক বাড়িতে ফিরে এসেছে। আর কিছু চাই না।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

বাসস এমডিকে ডিইউজের ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম

মুক্তি পেলেন ১৮৩ ফিলিস্তিনি

ফিক্সিং ইস্যুতে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের পথে বিসিবি

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে : নুর

পানিতে লাশের পাশে পড়েছিল মোটরসাইকেল

কৃষক লীগ নেতাকে বেঁধে রাখলেন এলাকাবাসী

‘জামায়াতের সমর্থন ছাড়া কেউই সরকার গঠন করতে পারবে না’

জানা গেল রোজা শুরুর সম্ভাব্য তারিখ

বাপূউপ প্রতিনিধি সভা / সংখ্যালঘুদের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে আশার আলো জাগাচ্ছে সেনাবাহিনী

এবার চীনকে নিশানা করলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

১০

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল দুই বন্ধুর

১১

আশুলিয়ায় ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৪ জনের লাশ উত্তোলন

১২

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের নামে কালক্ষেপণ করছে : ব্যারিস্টার খোকন

১৩

পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে অতর্কিত হামলায় ১৮ সেনা নিহত

১৪

আর কোনো পাতানো নির্বাচন বাংলাদেশ দেখবে না : হুম্মাম কাদের

১৫

শেখ হাসিনার ছবিযুক্ত ডাস্টবিনে ময়লা ফেললেন প্রেস সচিব

১৬

‘সরকারে থেকে দল গঠন করলে জনগণ মেনে নেবে না’

১৭

বিএনপির দুগ্রুপের সংঘর্ষ, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নিহত

১৮

সাতক্ষীরায় আ.লীগের ঝটিকা মিছিল

১৯

আইসিইউতে সাবিনা ইয়াসমীন

২০
X