গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরে আম বয়ানের মাধ্যমে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) বাদ মাগরিব বিশ্ব ইজতেমার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান। এর মাধ্যমে এবার ব্যতিক্রমভাবে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হলো।
এই পর্বে অংশ গ্রহণ করছেন ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে শূরায়ি নেজামের তাবলিগের সাথীরা। ইজতেমা উপলক্ষে নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। মুসল্লিদের সুবিধার্থে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।
ইজতেমায় মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, বিগত বছরগুলোতে শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মাধ্যমে ইজতেমা শুরু হলেও এবার মাগরিবের নামাজের পর আম বয়ান হয়েছে। নামাজের পর ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলার আম বয়ানের মাধ্যমে এবারের টঙ্গীর ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। বয়ানের তরজমা করেছেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়ের। শুক্রবার বাদ ফজর বয়ান করবেন, পাকিস্তানের মাওলানা জিয়া উল হক। সকাল ১০টায় বিভিন্ন খিত্তায় খিত্তায় তালিমের আমল হবে। দুপুরে অনুষ্ঠিত হবে বৃহত্তম জুমার নামাজ। জুমার নামাজ পড়াবেন মাওলানা মুহাম্মদ জুবায়ের।
ইজতেমা ময়দান ঘুরে দেখা গেছে, গতকাল থেকেই প্রথম পর্বের ইজতেমায় অংশগ্রহণের জন্য বিভিন্ন খিত্তা ও পয়েন্টের জিম্মাদার মুসল্লিরা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন। যারা ইজতেমা ময়দানে এসেছেন তারা তাদের নিজ নিজ খিত্তায় অবস্থান করছেন। দেশ বিদেশের মুসল্লিদের এ ঢল থাকবে শুক্রবার পর্যন্ত। এবারের ইজতেমা ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে শুরায়ী নেজামের অধীনে দুই ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রথম পর্ব ৩১ জানুয়ারি শুরু হয়ে ২ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ৩ ফেব্রুয়ারি। আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক হাবিবুল্লাহ রায়হান বলেন, এবার প্রথম শুরায়ী নেজামের অধীনে দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্বে ঢাকাসহ ৪১ জেলার মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করবে। এই পর্বে অংশ গ্রহণ করছে গাজীপুর, টঙ্গী, ধামরাই, গাইবান্ধা, মিরপুর, কাকরাইল, নাটোর, মৌলভীবাজার, রাজশাহী, দোহার, ডেমরা, কাকরাইল, নড়াইল, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নবাবগঞ্জ, নীলফামারী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, শেরপুর, ফরিদপুর, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পিরোজপুর, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, রাজবাড়ী জেলার মুসল্লিরা। এছাড়া এরই মধ্যে ৫০টির বেশি দেশের বিদেশি মুসল্লিরা ইজতেমা ময়দানে এসেছেন। তারা মূল ময়দানের পশ্চিম পাশে তাদের নির্ধারিত কামরায় অবস্থান করছেন।
তিনি বলেন, তাবলিগের মেহনত একটি দ্বীনের অন্যতম মেহনত এবং দ্বীনের ধারক-বাহক হচ্ছেন ওলামায়ে কেরাম। ধর্মপ্রাণ মুসল্লি ভাইয়েরা উলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে থেকেই তাবলিগের মেহনত করতে চান। এই সংখ্যাটা এত ব্যাপক যে, টঙ্গী মাঠের ১৬০ একর জায়গায় তাদের অবস্থান করাটা খুবই কষ্টদায়ক হয়ে যায়। এজন্য এবার দুই ধাপে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এদিকে, ইজতেমা সফল ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ডেসকো, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশনসহ নানা সেবা প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
এ ব্যাপারে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজোয়ান হোসেন বলেন, এবার মুসল্লিদের সুবিধার্থে ৯ হাজার পাকা টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের ওযু, গোসলের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করা হবে।
এ ছাড়া ইজতেমার নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা বলয়। পুরো ময়দান ৫টি সেক্টরে ভাগ করে কাজ শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ ব্যাপারে গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান বলেন, এবার ইজতেমায় পোশাকধারী পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় সাত হাজার সদস্য থাকবে। ময়দান এলাকায় র্যাবের হেলিকপ্টার টহল ছাড়াও বোমা ডিসপোজাল ইউনিট এবং ডগ স্কোয়াড থাকবে। সাদা পোশাকে প্রচুর নিরাপত্তা রেখেছি। এ ছাড়া ১৬টি ওয়াচ টাওয়ার থাকবে। সেখান থেকে বাইনোকুলার দিয়ে পুরো মাঠ দেখা হবে। ১৫টি সাব কন্ট্রোল কক্ষ থাকবে। সাব কন্ট্রোল কক্ষে যে কোনো রিপোর্ট করলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারব।
তিনি বলেন, ড্রোনের মাধ্যমে আমরা পুরো এলাকা মনিটর করব যেন কোথাও কোনো ধরনের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পুরো মাঠ ৩৩৫টি সিসি ক্যামেরার আওতাধীন থাকবে, ৩৫টি রুফটফ থাকবে, স্থির ব্রিগেড থাকবে ৫৩টি, ২০টি মোবাইল পার্টি সার্বক্ষণিক ডিউটিতে থাকবে, ২০টি চেকপোস্ট থাকবে- তাদের কাজ হবে যেন দুষ্কৃতকারী ময়দানে প্রবেশ করতে না পারে।
নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, পাঁচটি সেক্টরে ভাগ করে নিরাপত্তাকে সাজানো হয়েছে। র্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, জেলা প্রশাসক, সিটি কর্পোরেশন, সড়ক জনপথ, ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে সমন্বয় সভা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া ইজতেমার নিজস্ব ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী নিরাপত্তায় পুলিশের সঙ্গে কাজ করবে।
তুরাগ তীরের এ ময়দানকে ঘিরে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি বলেন, ফুটপাত উচ্ছেদ করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে, ট্রাফিক ব্যবস্থা সুন্দর হওয়ার জন্য ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পণ্যবাহী ট্রাক এ সড়ক দিয়ে ঢুকতে দেওয়া হবে না। মোনাজাতের দিন কোনো গাড়ি চলতে দেব না ইজতেমা এলাকায়, সেখানে গাড়ি চলাচল মুক্ত রাখা হবে, যেন মুসুল্লিদের কোনো সমস্যা না হয়।
বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে স্টেশন রোডসহ ময়দানের চারপাশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে অর্ধশত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। টঙ্গী ২৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালের পক্ষ থেকেও ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. আফজাল হোসেন বলেন, টঙ্গী হাসপাতালকে ইজতেমার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ ও একটি হৃদরোগ ইউনিট, একটি বক্ষব্যাধি ইউনিট, অ্যাজমা ইউনিট, ট্রমা ইউনিট, অর্থোপেডিক ইউনিট ও বার্ন ইউনিট, ১৫টি স্যানিটেশন টিম এবং ২৫টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব ৩ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। এরপর আট দিন বিরতি দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সাদপন্থিদের ইজতেমা শুরু হবে, যা ১৬ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে।
মন্তব্য করুন